ছোটদের প্রণোদনা ঋণে ব্যাংকের গড়িমসি

0
304

বারবার সময় বৃদ্ধি, ছাড় ও প্রচারণা চালিয়েও ছোটদের জন্য সরকারঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদণা প্যাকেজের ঋণ বিতরণ শেষ করা যায়নি। এখনো এ তহবিলের ঋণ বিতরণ বাকি আছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এমন অবস্থায় এক বছরের মাথায় এসে গত এপ্রিলে আবারও এ তহবিলের ঋণ বিতরণের সময়সীমা আরো তিন মাস বাড়ানো হয়েছে, যা আগামী ৩০ জুন শেষ হবে।

উদ্যোক্তা সংগঠনগুলোর অভিযোগ, করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও তাদের উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ঋণ পাচ্ছেন না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা অজুহাত তাদের ঋণ দিতে গড়িমসি করছে। তবে ব্যাংকগুলোর দাবি, ঋণ নিতে উদ্যোক্তারারাই যোগাযোগ করছেন না। আবার যাঁরা আসছেন তাঁরাও ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় কাগজ জমা দিতে পারছেন না। তাই ঋণ বিতরণ কম হচ্ছে।

মহামারি করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় বিভিন্ন খাতে প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। এর মধ্যে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ অন্যতম। গত ৫ এপ্রিল এ প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর ১৩ এপ্রিল এ তহবিল বরাদ্দের নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথমে অক্টোবরের মধ্যে এই তহবিলের ঋণ বিতরণ সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় দফায় সময় বাড়িয়ে ৩০ নভেম্বর, তৃতীয় দফায় ৩১ ডিসেম্বর, চতুর্থ দফায় ৩১ মার্চ এবং গত মাসে পঞ্চম দফায় তিন মাস বাড়িয়ে জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে।

গত ১২ এপ্রিল এ প্যাকেজের ঋণ বিতরণের সময় বৃদ্ধি সংক্রান্ত সার্কুলারে বলা হয়, কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে না পারায় সিএমএসএমই খাতে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ও সেবা প্রসার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মী বহাল রাখাসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন অবস্থায় প্যাকেজের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রণোদনা প্যাকেজটির প্রথম পর্যায়ের বাস্তবায়নের সময়সীমা ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত ১৭ জুন পর্যন্ত এই তহবিল হতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১৪ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। এটি মোট বরাদ্দের ৭৪.৫৭ শতাংশ। এর মানে এখনো পাঁচ হাজার ৮৭ কোটি টাকার তহবিল বিতরণ বাকি আছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, করোনার কারণে গত বছরের রোজা ও দুই ঈদে ব্যবসা ভালো যায়নি। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এমন অবস্থায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঘুরে দাঁড়াতে প্রণোদনার ঋণ আরো সহজলভ্য করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার ক্ষতি কাটাতে ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলোর জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ, সেটা ঠিকভাবে বিতরণ করা হয়নি। এ কারণে তহবিলের বড় একটি অংশ এখনো পড়ে আছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। তাই এ তহবিলের ঋণ বিতরণ বাড়াতে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, এনজিও, এসএমই ফাউন্ডেশন ও পিকেএসএফকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।’

সূত্র জানায়, এ তহবিলের ঋণ বিতরণে অগ্রাধিকার দিতে নীতিমালা জারির শুরুতেই প্রতিটি ব্যাংকে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু শুরুতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে কোনোক্রমেই গতি আসছিল না। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির জন্য তদারকি বাড়ানোর অংশ মাসিক ভিত্তির পরিবর্তে পাক্ষিক ভিত্তিতে ঋণ বিতরণের তথ্য জানাতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাতেও কোনো কাজ না দেওয়ায় গত বছরের জুলাই ও আগস্টে ঋণ বিতরণের টার্গেটের সীমা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এর পরও ঋণ বিতরণে গতি আসেনি। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই এ তহবিলের ঋণ বিতরণ বাড়াতে প্রচারণা চালানো হয়।

করোনাভাইরাসে ক্ষতির প্রভাব নিয়ে গত বছরের অক্টোবরে পাঁচ শতাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ওপর একটি জরিপ করে বিশ্বব্যাংকের আইএফসি এবং যুক্তরাজ্যের এফসিডিও। সেখানে উঠে আসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ৯১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান নগদ প্রবাহের সংকটে পড়েছে। এ খাতের ৯৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের বিক্রি ব্যাপক কমেছে। ৩৭ শতাংশ শ্রমিক স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে কাজ হারিয়েছেন। সিএমএসএমই খাতে এমন খারাপ অবস্থা দেখা দিলেও ঋণ বিতরণ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

করোনাভাইরাসের ক্ষতি সামলে উঠতে সিএমএসএমই খাতে আরেকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। প্যাকেজটির নাম দেওয়া হয়েছে, ‘কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড ক্রাইসিস রেসপন্স ফ্যাসিলিটি প্রজেক্ট (সিইসিআরএফপি)’। দুই হাজার ৫২০ কোটি টাকার এই প্যাকেজের অর্থ জোগান দিচ্ছে উন্নয়ন সংস্থা এশীয় অবকাঠামো ও বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি)।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রগ্রামস বিভাগের মাধ্যমে এ প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হবে। গত বুধবার এ প্যাকেজ বরাদ্দের নীতিমালা জারি করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, এ তহবিলের মেয়াদ হবে তিন বছর। সুদের হার ৪ শতাংশ। এক বছরের বেশি সময়ের মহামারিতে যে সব ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের ঘুরে দাঁড়াতে এই তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here