আমরা দেখেছি যে একটা স্টার্টআপ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ বা এসএমইর তুলনায় আরও অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং বেশি বিনিয়োগের ব্যাপার। তারপরও কেন বিনিয়োগকারীরা স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে? যেকোনো স্টার্টআপে বিনিয়োগ করা পুরোটাই একটি ঝুঁকি বণ্টনের খেলা। একজন স্টার্টআপ বিনিয়োগকারী তাঁর পুরো মূলধনের খুব অল্প পরিমাণ টাকা একটি স্টার্টআপে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু একসঙ্গে ১০টি ভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। কেন? কারণ, তাঁরা জানেন, টাকাটা আসলে কখনো লাভসমেত ফেরত না–ও আসতে পারে। তাঁরা ধরেই নেন, তাঁদের বিনিয়োগের সাতটি কোম্পানি ব্যর্থ হবে, তবে আশা করেন, যে তিনটি কোম্পানি সফল হবে, তারা অন্য সাতটির খরচ পুষিয়ে দেবে। স্টার্টআপ বিনিয়োগকারীরা স্কেল করতে পারেন, এ রকম কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
স্টার্টআপ আর এসএমইর মধ্যে একটা বড় পার্থক্য হলো তাদের বের হওয়া বা ‘এক্সিট স্ট্র্যাটেজি’। বেশির ভাগ এসএমই চাইবে প্রতি মাসে অল্প অল্প করে ব্যবসা বড় করে বছরের পর বছর চালিয়ে যেতে। যদি কোনো বিনিয়োগকারী তাঁদের শেয়ার বিক্রি করতে চান, তাহলে উদ্যোক্তার যথেষ্ট টাকা থাকলে তার কাছেই বিক্রি করতে পারবেন।
অন্যদিকে একটি স্টার্টআপের অবশ্যই পরিষ্কার এক্সিট স্ট্র্যাটেজি থাকতে হবে। সাধারণত উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য তিনটি উপায় থাকে:
১. একুইজেশন বা অধিগ্রহণ: কেউ একজন উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের শেয়ারসহ পুরো কোম্পানি কিনে নেন। যদি কোম্পানি কৌশলগতভাবে যথেষ্ট পরিমাণ মূল্যবান মনে হয়, তা শুরুর দিকেও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যখন আমাজন ৯৭ কোটি ডলার দিয়ে টুইচ কিনে নেয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বুঝতে পেরে এবং নিজেদের এডব্লিউএসের (আমাজন ওয়েব সার্ভিসেস) সুবিধা নিয়ে কম খরচের জন্য আমাজন টুইচ কিনে নেয়।
২. প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও: কোম্পানিটি কোনো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। গুগল (বর্তমান মূল্য ৯২ কোটি ৫০ লাখ ডলার) শুরুতে মাত্র ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ তুলতে পেরেছিল আইপিওভুক্ত হওয়ার আগে, এটির মূল্য তখন ছিল মাত্র ২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। বিনিয়োগকারী এবং প্রতিষ্ঠাতারা তখন তাঁদের শেয়ার বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই অবস্থাতেই।
৩. সেকেন্ডারি বাজারে বিক্রি: গোজেক, একটি ইন্দোনেশিয়ান ইউনিকর্ন এবং পাঠাওয়ে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, সম্প্রতি এক হাজার কোটি ডলারের সিরিজ এফ বিনিয়োগ তুলেছে। তার মধ্যেই বিনিয়োগকারীরা, যাঁরা সিরিজ এ বা সিরিজ বিতে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের শেয়ার নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে ফেলতে পেরেছিলেন। প্রতিষ্ঠাতাদের ক্ষেত্রে তাঁদের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার সুযোগটা এমন অবস্থায় সাধারণত হয় না, কিন্তু এই ব্যাপার আসলে আরও অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে।
বের হওয়ার বা এক্সিটের কোনো সেরা উপায় বলতে কিছু আসলে নেই, কিন্তু একটি স্টার্টআপের জন্য সেরা এক্সিট স্ট্র্যাটেজি জেনে রাখা খুবই দরকারি।
উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, উবার এত বড় কোম্পানি হয়ে গিয়েছিল যে তাদের জন্য অধিগ্রহণের চেয়ে আইপিও বেছে নেওয়াই উত্তম ছিল। কেননা, খুব কমসংখ্যক বৈশ্বিক কোম্পানিরই উবারকে কিনে নেওয়ার সামর্থ্য ছিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে, মাথায় রাখতে হবে যে একজন বিনিয়োগকারী এবং একজন প্রতিষ্ঠাতা, উভয়ের জন্যই এক্সিট করার উপায়গুলো জেনে রাখা বেশ দরকারি, যাতে সবাই সবার বিনিয়োগ করা টাকা লাভসহ ফেরত পেতে পারে।
আপনার স্টার্টআপটি ব্যবসায়িকভাবে সফল না হতে পারে বা স্কেল না করতে পারে, তাহলে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কোভিড-১৯–এর পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যাপারটি বোঝা আরও একটু বেশি জরুরি। কেননা, এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায় লাভ করা প্রকৃতপক্ষেই বেশ কঠিন। এ রকম অবস্থায় আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানকে একটি ‘লাইফস্টাইল’ কোম্পানিতে পরিণত করতে পারেন, মানে, ভবিষ্যতে আরও বিনিয়োগের এবং এক্সিটের চিন্তা না করে ব্যবসাটিকে স্থিতাবস্থায় নিয়ে আসা, কিংবা এই যাত্রায় ক্ষান্ত দেওয়া। কেননা, ‘ব্যবসায় ক্ষতি হবে’ এটা যখন জানা, তখন তাতে আরও টাকা খাটানোর সিদ্ধান্ত খুব একটা ভালো সিদ্ধান্ত নয়।
একটি স্টার্টআপের যদিও উচিত লাভজনক হওয়ার চেষ্টা করা, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যে তাদের মূল্য নিরূপণ যাতে বেশি হয় এবং সবশেষে মার্কেট এক্সিট বা প্রস্থানের ব্যবস্থা।
আদতে একটি স্টার্টআপকে একটি এসএমই থেকে পৃথক করে তার বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের আদর্শ বা নীতিসমূহ। কেননা, ঝুঁকির সঙ্গে সম্ভাব্য পারিতোষিকের মিল থাকতেই হবে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য আরও একটা ব্যাপার বোঝা খুব জরুরি, একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী কেন শুধু বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাইবেন, যদি তিনি তাঁর নিজের দেশেই একই রকম লভ্যাংশ ফেরত পেয়ে থাকেন? বিদেশি বিনিয়োগ নিতে হলে, অবশ্যই অধিকতর রিটার্নের সুযোগ থাকতে হবে।
তবে আপনার নতুন উদ্যোগ তবে কী? স্টার্টআপ না এসএমই? একজন প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এই পার্থক্যটা করতে পারা জরুরি, যাতে বিনিয়োগকারীরা আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যথাযথ ধারণা পেতে পারেন।