রেমিট্যান্স আয় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে গত বেশ অনেক দিন ধরেই। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা সংকট বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাভাব সৃষ্টি করলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তেমন বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারেনি রেমিট্যান্স আয়ের কারণে।
সাম্প্রতিক এক বছরে বিদেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২৩ শতাংশ বাড়লেও এ দেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানিতে ভাটার টান সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। হালে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত প্রণোদনার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে নতুন গতির সঞ্চার হয়েছে। এখন প্রবাসীরা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে পরিবার পরিজনের কাছে টাকা পাঠানোটাকে তুলনামূলকভাবে লাভজনক, ঝুঁকিমুক্ত এবং নিরাপদ মনে করছেন। রেমিট্যান্স প্রবাহে গতি আরো বাড়াতে হলে বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বিদেশ থেকে অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স আনতে হলে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তি পাঠাতে হবে। এমনিতে যেখানে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে আসছে তার ওপর যারা বিদেশে যাচ্ছেন তারা অদক্ষ হওয়ায় তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দেশ থেকে যাওয়া দক্ষ কর্মীদের চেয়ে অনেক কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, এশিয়ার সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, মালদ্বীপ, হংকং, আফ্রিকা, আমেরিকা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যারা চাকরির জন্য যাচ্ছেন তারা বিশেষ কোনো পেশায় পারদর্শী না হয়ে, কারিগরি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অথবা উন্নত প্রশিক্ষণ না নিয়ে অদক্ষ কর্মী হিসেবে কোনোভাবে সে দেশে পা রাখছেন। উদ্দেশ্য কোনো না কোনোভাবে একটা কাজ জুটিয়ে নেওয়া। কিন্তু এ ধরনের অদক্ষ, কারিগরি জ্ঞান না থাকা, যে দেশে যাচ্ছেন সে দেশের ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা না থাকা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো শ্রমবাজারে এক ধরনের ঋণাত্মক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কর্মীরা বিদেশে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করেন বটে, কিন্তু কারিগরি শিক্ষা না থাকায় তাদেরকে অদক্ষ, আধাদক্ষ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা তাদের শ্রমের উপযুক্ত মূল্য পায় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। নিজেদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার কারণে তাদের স্বল্প বেতনে চাকরি করে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এখন সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার আগে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষালাভের জন্য তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এজন্য সরকারি উদ্যোগে দেশব্যাপী কারিগরি শিক্ষালাভের জন্য অনেক ইনস্টিটিউট, ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। যেখানে মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, সিভিল অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ওপর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান স্বল্প খরচে নানা ধরনের কারিগরি বিষয়ে জ্ঞানলাভের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষ, অভিজ্ঞ, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে চাহিদাসম্পন্ন করে তোলা সম্ভব। দেশেই হোক কিংবা বিদেশেই হোক শ্রমবাজারে নিজেদের দাম বাড়াতে হলে কারিগরি শিক্ষালাভকারী দক্ষ অভিজ্ঞ কর্মীরা বেশ ভালো এবং সুবিধাজনক অবস্থায় থাকেন সব সময়। ব্যক্তিগত জীবনেও উন্নতির জন্য নিজ নিজ ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন একান্ত প্রয়োজন। তবে দক্ষতা রাতারাতি অর্জন করা সম্ভব নয়। মূলত উন্নত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং কর্মপরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। একটি বিষয় সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে যে, আমাদের যে বিপুল জনসংখ্যা তাকে জনশক্তি বা জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে না পারলে, জনসংখ্যার বিরাট বোঝার চাপে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো নানাভাবে বিপর্যস্ত হবে। দেশকে সমৃদ্ধ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে হলে জনসংখ্যার বিরাট বোঝাকে অভিশাপ মনে না করে আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ-তরুনীরাই আমাদের অর্থনীতির চেহারাটা আরো বদলে দিতে পারে। দেশে-বিদেশে ভালো বেতনে দক্ষ কর্মী বিবেচনায় চাকরি পেতে তাদের তেমন বেগ পেতে হয় না। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে উচ্চ পারিশ্রমিকে কর্মী হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে প্রবাসী রেমিট্যান্স ধারায় আরো বিপুল জোয়ার সৃষ্টি করা যায়।
Source – Ittefaq.