উত্তরের নতুন সম্ভাবনা, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির উর্বর ক্ষেত্র

0
374
  • চায়ে পাল্টে যাচ্ছে সমতলের চিত্র

উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমি এখন দুটি পাতা একটি কুঁড়ির উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত। ২০ বছর আগেও যা ভাবা যায়নি, তাই এখন বাস্তব। পূর্বের চিত্র পাল্টে অর্থনীতির নতুন দুয়ার খুলেছে চা। ১৯৯৯ সালে সর্ব উত্তরের পঞ্চগড় জেলায় চা চাষ শুরু হয়ে ক’বছরের মধ্যে ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। আবহাওয়া বিশ্লেষণে বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের অন্যসব জেলা চা আবাদের অনুকূলে কিনা তার গবেষণা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে চা প্রজাতির কফি উৎপাদনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো তৃতীয় চা অঞ্চল। উত্তরাঞ্চলের চা বিদেশে রফতানি হচ্ছে।

গত বছর চা মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের উল্লেখিত ৫ জেলায় ১ কোটি ৩ লাখ কেজি চা পাতা উৎপাদন হয়। যা দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চা উৎপাদন এবং জাতীয় চা উৎপাদনে ১২ শতাংশ। এই চায়ের নিলাম মার্কেট ছিল ১৫৭ কোটি টাকা। ১৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। চা বাগান কর্তৃপক্ষ বলছেন, কোভিড-১৯ কারণে গত বছর চা পাতা উৎপাদনে ভাটা পড়েছিল। চলতি মৌসুমে তা কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে। তারা আশাবাদী চলতি মৌসুমে উৎপাদন বাড়বে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের হিসাবে মার্চ থেকে নবেম্বর চা পাতা উত্তোলন মৌসুম। নয় মাসের মৌসুমে ৬ থেকে ৭ বার কাঁচা চা পাতা সংগ্রহ করা যায়। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই তিন মাস সার্বিক পরিচর্যা, জৈব ও রাসায়নিক সারের মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগ প্রনিং বা বর্ধিত অংশ কেটে অধিক সংখ্যায় নতুন পাতা গজিয়ে ওঠার ব্যবস্থা নেয়া হয়। কৃষি খাতের অন্য আবাদের চেয়ে চা বাগান আর্থিক লাভজনক হওয়ায় চা ভূমির উপযুক্ত এলাকার কৃষক চা আবাদে ঝুঁকে পড়ছেন। এভাবে বড় চা বাগানের পাশাপাশি ছোট ও ক্ষুদ্র চা বাগান তৈরি হচ্ছে।

পঞ্চগড়ের একদার ক্ষুদ্রায়তনের চা আবাদ (বাগান) আজ বড় চা বাগানে পরিণত। পঞ্চগড়ের সাফল্যে পাশের জেলার অনেকে ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ (এক বিঘা থেকে ৩ বিঘা) জমিতে চা আবাদ শুরু

করেছে। চা আবাদের সাফল্যে তাদের জীবনমান পাল্টে গেছে। ২০ বছর আগে এই এলাকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস কৃষিজাত পণ্য ধান পাট গম আখ ইত্যাদি। বর্তমানে চা আবাদে এসেছে নীরব বিপ্লব। এসব এলাকায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক লাখেরও বেশি নারী-পুরুষ চা আবাদে লাভবান।

১৯৯৬ সালে তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পঞ্চগড়ে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ শুরু হয়। ওই সময়ে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক ছিলেন রবিউল ইসলাম। তিনি সার্বিক বিষয় মনিটরিং করেন। তিন বছর পর সাফল্য আসে। ১৯৯৯ সালে চা বোর্ডের বিশেষজ্ঞ দল উত্তরবঙ্গের মাটি পরীক্ষা করেন। তারা পঞ্চগড় ঠাকুরগাঁও এলাকার মাটিকে চা বাগানের উপযোগী রিপোর্ট দেন। পাশর্^বর্তী জেলাগুলোর মাটির গবেষণা শুরু হয়। পরবর্তী বছরে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় উপজেলার সীমান্তে চা বাগান তৈরি হতে থাকে। উল্লেখ্য, তেঁতুলিয়া সীমান্তের ওপারে ভারতীয় চা বাগান। মৃত্তিকার একই ধরন থাকার পরও কেন এতদিন সেখানে চা বাগান হয়নি বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেন গবেষকগণ। তেঁতুলিয়ায় নদী ও মাটির নিচে থেকে এখনও নুড়ি পাথর সংগ্রহ করা হয়। ২০০১ সালে উত্তরাঞ্চলের চা শিল্পের অগ্রযাত্রায় পঞ্চগড়ে বাংলাদেশে চা বোর্ডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি উপকেন্দ্র স্থাপিত হয়। পরে এই প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিক চা বোর্ডের পরিচিতি পায়।

পঞ্চগড়ে চা চাষ শুরুর পর ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটে চা চাষের প্রসার ঘটে। ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী এলাকায় চা চাষ সম্প্রসারিত হয়। এই ৫ জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত চা বাগান ১০টি এবং অনিবন্ধিত চা বাগান ১৭টি। যে চা বাগানগুলো ২৫ একরের উর্ধে ভূমিতে। এ ছাড়াও ছোট ও ক্ষুদ্রায়তনের (১ থেকে ২৫ একরের নিচে) নিবন্ধিত চা বাগান ১ হাজার ৫১০টি। অনিবন্ধিত চা বাগান ৫ হাজার ৮শ’টি। এই পাঁচ জেলায় মোট ১০ হাজার ১৭১ একর জমিতে চায়ের চাষ হচ্ছে। চা আবাদের জরিপকারী দল জানাচ্ছেন উত্তরাঞ্চলের অন্তত ৭০ হাজার একর সমতল ভূমি চা বাগানের উপযোগী।

সূত্র জানায়, পঞ্চগড়ে ১৭টি চা ফ্যাক্টরি এবং ঠাকুরগাঁয়ে একটি চা ফ্যাক্টরি আছে। ২০১৯ সালে এসব ফ্যাক্টরিতে ৯৬ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, ওই এলাকায় আরও ১৫টি চা ফ্যাক্টরির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ফ্যাক্টরিতে প্রতি কেজি চা পাতা মানভেদে কেনা হয় ২৪ টাকা থেকে ৩৫ টাকা দরে। নিবন্ধিত চাষীদের স্বল্পমূল্যে বিটি-২ জাতের চা চারা বিতরণ ছাড়াও উন্নতমানের চা পাতা চাষে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। উত্তরাঞ্চলে চায়ের নিলাম বাজার স্থাপনে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে।

চা পানকারী ॥ চা বোর্ডের হিসাব- দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রতিদিন অন্তত ১১ কোটি চায়ের কাপে চুমুক পড়ে। প্রতি কাপ চা ৫ টাকা দরে হিসাবে তা ৫৫ কোটি টাকা। চা পানকারীর সংখ্যা প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০০১ সালে গড়ে একজন মানুষ বছরে ১১৩ কাপ চা পান করত। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ২২৯ কাপ হয়। ২০২০ সালে আরও কয়েকগুণ বাড়ে।

চা শিল্পের আদিকথা ॥ চা শিল্পের ইতিহাস ১৮০ বছরের। দেশে প্রথম চা চাষ হয় ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে। এর ১৪ বছর পর ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয়ে চা বাগান তৈরি হয়। চা পাতা তুলতে হয় খুব যতনে। দুটি পাতার সঙ্গে একটি করে কুঁড়ি থাকতে হয়। যে কারণে চা পরিচিতি পেয়েছে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি নামে। ১৯৫১ সালে স্থাপিত হয় চা বোর্ড। ১৯৫৭ সালের ৪ জুন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন চা বোর্ডের প্রথম বাঙালী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর তিনি চা শিল্পের প্রসার ঘটাতে শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্চ স্টেশন ও ল্যাবরেটরি স্থাপন করেন। প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নিয়ে চা শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যান। টি এ্যাক্ট-১৯৫০ সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য চালু করেন কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড। দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করে মালিকানাবিহীন পরিত্যক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ নেন। ১৯৭৩ সালে শ্রীমঙ্গলের টি রিসার্চ স্টেশনকে বাংলাদেশ টি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (বিটিআরআই) রূপান্তরিত করে গবেষণার দুয়ার প্রসারিত করেন। ধাপে ধাপে উন্নীত হয় চা শিল্প।

চায়ের উৎপাদন ॥ ১৯৭০ সালের চায়ের উৎপাদন ছিল ৩১ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন কেজি। ২০২০ সালে ৮৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন কেজি। ২০১৯ সালে ৯৬ দশমিক ০৭ মিলিয়ন কেজি চা পাতা। বর্তমানে নিবন্ধিত চা বাগান ১৬৬টি। বাংলাদেশের চা রফতানি হচ্ছে বিশ্বের ১৯টি দেশে। যে পরিমাণ গত বছর ছিল ২ দশমিক ১৭ মিলিয়ন কেজি। রফতানি আয় হয় ৩৫ কোটি টাকা। রফতানি বাজার বাড়ছে। বেশি চা রফতানি হয় ইউনাইটেড আরব আমিরাতে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কুয়েত, সৌদি আরব, চীন ও ব্রিটেনে বাংলাদেশের চায়ের চাহিদা বেড়েছে। তবে একেকটি দেশে একেক ধরনের চা জনপ্রিয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ব্ল্যাক টি, গ্রীন টি ও অর্থোডক্স টি। আরব আমিরাতে ব্ল্যাক টি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here