মেইড ইন বাংলাদেশ গাড়ির অপেক্ষা

0
297

নতুন বাজেটে শিল্প খাতে যেসব কর অব্যাহতি ঘোষণা করা হয়েছে, তার মধ্যে অটোমোবাইল কারখানা স্থাপনের সুবিধাটি সবচেয়ে বড়। এ খাতে বিনিয়োগ করলে উদ্যোক্তারা টানা ২০ বছর কর অব্যাহতি পাবেন। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, গাড়িতে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ এখন সময়ের অপেক্ষামাত্র। বাজেটের সুবিধার বাইরে সরকার এ খাতের উন্নয়নে একটি নীতিমালা করছে।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ প্রধানত রিকন্ডিশন্ড বা ব্যবহূত গাড়ির বাজার। জাপানের ব্যবহূত গাড়ির ক্রেতা বেশি। যদিও কয়েক বছর ধরে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ২০ শতাংশ নতুন গাড়ি বিক্রি হচ্ছে, যার মধ্যে দেশের কারখানায় সংযোজিত গাড়িও রয়েছে। মানুষের আয় বৃদ্ধি এবং গাড়ি কেনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লগ্নির ফলে ব্যক্তিগত গাড়ির চাহিদা বেড়েছে। মিতসুবিশি, টয়োটা, হুন্দাই, নিশান, ফোর্ড, টাটা, মাহিন্দ্র, হিনো, অশোক লেল্যান্ডসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অনুমোদিত বিপণন প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশে। আগামীতে নতুন গাড়ির বাজার আরও বড় হবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে কর অবকাশের মতো নীতি সহায়তা গাড়িশিল্পের বিনিয়োগে অনুঘটকের কাজ করবে। তবে এ সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে অটোমোবাইলের সংযোগশিল্প গড়ে তোলা, গাড়িতে ব্যবহারযোগ্য স্টিলের সরবরাহ বাড়ানো এবং দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগও দরকার।

যারা সংযোজন করছে :বর্তমানে দেশে যেসব কোম্পানি গাড়ি সংযোজন করে তাদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সংস্থা প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন মডেলের আট ধরনের গাড়ি সংযোজন করে থাকে। এর মধ্যে মিতসুবিশির পাজেরো স্পোর্টস প্রধান। বছরে বিভিন্ন মডেলের হাজার দেড়েক গাড়ি বিক্রি করছে প্রগতি। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তৌহিদুজ্জামান সমকালকে বলেন, সরকার মোটরগাড়ির কারখানা স্থাপনে যে কর ছাড় দিয়েছে, তা অবশ্যই ইতিবাচক। এতে বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। ২০১৭ সাল থেকে মালয়েশিয়ার প্রোটন ব্র্যান্ডের গাড়ি সংযোজন করছে চট্টগ্রামের পিএইচপি মোটরস। ইফাদ অটোস ধামরাইয়ের কারখানায় গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহনের গাড়ি সংযোজন করে বাজারজাত করছে। গত তিন বছর ধরে র‌্যাংগস মোটরস মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার এসইউভি সংযোজন করে বিক্রি করছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গাড়ি সংযোজন করছে। হোসেন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ‘বাংলা কার’ নামে দেশি ব্র্যান্ড চালু করেছে। এদের কারখানা নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটিতে। ইতোমধ্যে কোম্পানিটি ৩০টি এসইউভি গাড়ি তৈরি করেছে। করোনার কারণে এ কারখানাটি বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ ছিল। আগামী ২০ জুন থেকে কারখানা পুনরায় চালু হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন। ফেয়ার টেকনোলজি লিমিটেড গাড়ির জগতে পা রেখেছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাই-টেক পার্কে তারা একটি প্লট নিয়েছে গাড়ি সংযোজন কারখানা স্থাপনে।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে হচ্ছে অটো হাব :চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটি কোম্পানি গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা স্থাপনে উদ্যোগ নিয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব পেয়ে এখানে অটোমোবাইল হাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এখানে ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করছে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ। এছাড়া উত্তরা মটরস, ইফাদ গ্রুপ এই শিল্পনগরে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়ে পরিকল্পনা প্রস্তাব জমা দিয়েছে। জাপানের মিতশুবিসি এবং অটোমোবাইল খাতের দেশি-বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত উদ্যোগ ‘স্টার অ্যালায়েড’ এই শিল্পনগরে গাড়ির যন্ত্রাংশ ও উপকরণ তৈরির জন্য কারখানা স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়েছে। এছাড়া গাড়ির কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে নিটল নিলয় গ্রুপ। কিশোরগঞ্জে নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতের টাটার সঙ্গে যৌথভাবে অটোমোবাইল কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছে তারা। এদিকে ওয়ালটন বিভিন্ন ধরনের মোটরগাড়ি, গাড়ির যন্ত্রাংশ, ইঞ্জিন, বডি তৈরির জন্য পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর থেকে ট্রেডমার্ক সনদ নিয়েছে।

বর্তমান বাজার :বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে দেশে ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকানা বেড়েছে ১১শ শতাংশ। ১৫ বছর আগে অর্থাৎ ২০০৫ সালে দেশে নিবন্ধিত প্রাইভেটকারের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৩ হাজার ২১৫টি, যা ২০২০ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৭১ হাজার ৬২৫টিতে। বর্তমানে বছরে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বছরে বিভিন্ন মডেলের প্রায় ২৫ হাজার গাড়ি বিক্রি হয়। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দেশে গাড়ির বাজার খুব বড় নয়। দেশে উৎপাদনে গেলে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার এবং আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।

বাজেটে দেওয়া সুবিধা :’মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠায় সরকার থ্রি ও ফোর হুইলার গাড়ি উৎপাদনে ২০ বছরের কর অব্যাহতি সুবিধা ঘোষণা করেছে। এই কর অব্যাহতি পেতে উৎপাদকদের কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ২০৩০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে হবে। প্রথম ১০ বছর শতভাগ করমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য নিজ কারখানায় কমপক্ষে ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করতে হবে। সম্পূর্ণ করমুক্ত সুবিধা ভোগ শেষে নিজস্ব কারখানায় কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মূল্যসংযোজন করলে পরবর্তী ১০ বছর হ্রাসকৃত কর পরিশোধ করতে হবে। এ সুবিধা নিতে গেলে অনুমোদন পাওয়ার ৫ বছরের মধ্যে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব কারখানায় গাড়ির ইঞ্জিন, ট্রান্সমিশন সিস্টেম ও স্টিয়ারিং সিস্টেম সংযোজনসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতে হবে। এ বিষয়ে উত্তরা মটরসের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান সমকালকে বলেন, বাজেটে যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে তা দেশে অটোমোবাইল শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এ খাতে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here