দৃশ্যমান ৮ কোম্পানির নির্মাণযজ্ঞ

0
370

দেশে ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। বাড়ছে মানুষের জীবনযাত্রার মান। বদল ঘটছে রুচির। এসব বিবেচনায় রেখেই এ দেশে রঙের বাজার ধরতে চাইছে ভারতীয় কোম্পানি এশিয়ান পেইন্টস। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ২০ একর জায়গাজুড়ে তারা গড়ে তুলছে রঙের কারখানা। এটাকে এশিয়ার সর্ববৃহৎ রঙের কারখানা বলে দাবি কোম্পানি কর্তৃপক্ষের। এর আগে গাজীপুরে প্রথম কারখানা স্থাপন করে তারা।

সম্প্রতি সরেজমিনে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে দেখা গেল, এশিয়ান পেইন্টসের প্রকল্প এলাকার এখানে পাথর রাখা আছে তো ওখানে ইট, বালি, স্টিল ইত্যাদি স্তূপ করে রাখা। একাধিক খননযন্ত্রে অবিরাম কাজ চলছে। সব মিলিয়ে কাজ করছেন সাড়ে তিন শ শ্রমিক। তাঁরা যে যাঁর কাজে ব্যস্ত। কারও যেন দম ফেলার ফুসরত নেই। এভাবে এখন তৈরি হচ্ছে কাঁচামাল রাখার গোডাউন, প্রশাসনিক ভবন, পাম্পহাউস।

সেখানে শ্রমিকদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন এশিয়ান পেইন্টসের সহকারী প্রকৌশলী রইস উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর জানুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত পূর্ত কাজের ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ আগামী বছর জুনের মধ্যে শেষ করে ২০২১ সালের মধ্যেই রং উৎপাদন শুরু করা হবে।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তথ্য অনুযায়ী, ৩০ হাজার একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ৭৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৮ হাজার একরের মতো জমি বুঝিয়ে দিয়েছে বেজা। প্রতিনিয়ত আরও দেশি-বিদেশি নতুন নতুন বিনিয়োগ প্রস্তাব আসছে।

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে এরই মধ্যে দুই হাজার কোটি ডলারের মতো বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এই অর্থ বাংলাদেশের ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)।

বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১০ তলাবিশিষ্ট আবাসিক ভবনের নির্মাণকাজ চলছে
বসুন্ধরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১০ তলাবিশিষ্ট আবাসিক ভবনের নির্মাণকাজ চলছে

দৃশ্যমান আট প্রতিষ্ঠানের কারখানা

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর ঘুরে দেশি-বিদেশি আটটি শিল্পকারখানার অবকাঠামো নির্মাণের কাজ জোরেশোরে চলতে দেখা গেছে। তাদের বড় বড় ভবন নির্মাণের দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। এসব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ২০২১ সালের মধ্যেই তাঁরা পণ্য উৎপাদনে শুরু করতে চান। আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এখন জমি ভরাটসহ প্রাথমিক কাজগুলো সম্পন্ন করছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় বসুন্ধরা গ্রুপ বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ৫০০ একর জমি পেয়েছে। তাদের প্রকল্প এলাকায় ১০ তলাবিশিষ্ট ডরমিটরি ভবনের দোতলার ছাদ নির্মাণের কাজ শেষ। এটিকে বসুন্ধরা গ্রুপ পাঁচ তারকা হোটেল হিসেবে তৈরি করছে। বসুন্ধরা কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি ও বসুন্ধরা মাল্টি স্টিল মিলস নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে।

জানতে চাইলে বসুন্ধরার অর্থনৈতিক অঞ্চলের সমন্বয়ক ফয়জুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করছি, আগামী বছরের মধ্যেই উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হবে।’

এশিয়ান পেইন্টসের কারখানার প্লটে শ্রমিকেরা কাজ করছেন
এশিয়ান পেইন্টসের কারখানার প্লটে শ্রমিকেরা কাজ করছেন

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ২০ একর জায়গা পেয়েছে মডার্ন সিনটেক্স। তাদের কারখানা নির্মাণের কাজ অর্ধেক শেষ। কোম্পানির হেড অব ডিপার্টমেন্ট (সিভিল) প্রদীপ চন্দ্র পাল জানান, নির্মাণকাজ শেষ করে আগামী বছরেই উৎপাদনে যেতে চান তাঁরা।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বর্তমানে যে আটটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কারখানার নির্মাণকাজ দৃশ্যমান, তার মধ্যে আরও রয়েছে আরমান হক ডেনিম, নিপ্পন ও ম্যাকডোনাল্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রি ও ১৫০ কেভি পাওয়ার প্ল্যান্ট পাওয়ার জেন।

বেজার তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকসহ, জাহাজ নির্মাণ, ইস্পাত, অটোমোবাইল, বস্ত্র, স্টিলসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা হবে। বিনিয়োগকারীদের জন্য বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির ব্যবস্থাসহ রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজও শেষ করেছে বেজা।

জমি প্রস্তুত, যেতে গড়িমসি বিজিএমইএর

দেড় যুগ ধরে মুন্সিগঞ্জের বাউশিয়ায় একটি ‘পোশাকপল্লি’ করার কথা থাকলেও মালিকদের অনীহা ও খামখেয়ালির কারণে শেষ পর্যন্ত সেখানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। বাউশিয়ায় পোশাকপল্লি করতে ব্যর্থ হওয়া ব্যবসায়ীদের এক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, রাস্তাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় সরকার। তাতে রাজি হন পোশাকশিল্প মালিকেরা। ফলে বেজা সেখানে বিজিএমইএর অনুকূলে ৫০০ একর জমি বরাদ্দ দেয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তিও হয়।

বিজিএমইএকে দেওয়া ৫০০ একর জমির মধ্যে ৩২১ একরে ৬৩টি প্লট করা হয়েছে। বাকি জমি রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়ার জন্য বরাদ্দ থাকবে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে কারখানা তৈরির কাজ শুরু করেননি পোশাকশিল্প মালিকেরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, বিজিএমইএর পাওয়া জমিতে কেবল একটি বিশাল সাইনবোর্ডই টাঙানো আছে। অথচ প্রকল্প এলাকায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সুবিধাসহ রাস্তার কাজও করে দিয়েছে সরকার।

এত সুবিধা থাকতেও কেন বিজিএমইএ বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পোশাকপল্লি নির্মাণের কাজ শুরু করছে না, জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তাঁদের কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু করার জন্য বারবার তাগিদ দিচ্ছি। পোশাকশিল্প মালিকদের জন্য রাস্তা, গ্যাস, বিদ্যুৎ পানিসহ সব ধরনের সুবিধাই রয়েছে।’ রাস্তার পাশে যাঁদের প্লট রয়েছে, তাঁরা চাইলে কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারেন বলে জানান পবন চৌধুরী।

উদ্বোধনের অপেক্ষায় পাওয়ার জেনের ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র
উদ্বোধনের অপেক্ষায় পাওয়ার জেনের ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র

অন্যদিকে বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামাল বলেন, ‘পোশাক খাত একটি শ্রমঘন শিল্প। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে আমাদের যেখানে জমি দেওয়া হয়েছে, সেটি শিল্পনগর থেকে ২৭ কিলোমিটার ভেতরে। প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক কীভাবে কারখানায় যাবেন, আবার ফিরে আসবেন, সেটির সুরাহা হওয়া জরুরি। তা ছাড়া আমাদের শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে। করোনাভাইরাস এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে আমরা বেজার সঙ্গে বসেছি। আশা করছি, একটা সমাধানে আসতে পারব।’

বঙ্গোপসাগর ঘেঁষেই স্থাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর। সমুদ্র ঘেঁষে মোট ২৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here