করোনার শুরুতে লকডাউনের কারণে টাইলসের বেচাবিক্রি নেমেছিল শূন্যের কোঠায়। সেখান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে নির্মাণ তথা আবাসন খাতের এ পণ্যটির ব্যবসা। ব্যবসায়ীরা তাতে যেমন আশার আলো দেখছেন, তেমনি বন্ধ কারখানাগুলো আবার পুরোপুরি সচল হয়ে উঠেছে।
করোনার কারণে গত মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে আবাসন খাতের কার্যক্রম বলতে গেলে একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে এক থেকে আড়াই মাস পর্যন্ত উৎপাদনও বন্ধ রাখে টাইলস উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু গত জুন থেকে পরিস্থিতি একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে। প্রতিদিনই বাড়তে থাকে বিক্রি। আর এখন এসে টাইলস উৎপাদনের পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করছে কারখানাগুলো। বাজারে চাহিদাও বেড়ে গেছে। কাটতে শুরু করেছে নির্মাণ খাতের স্থবিরতা।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, গড়ে এ খাতে বর্তমানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বিক্রি ১৫-২০ শতাংশ কম। তবে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের অবস্থায় ফিরেছে। বিক্রি বাড়তে কেউ কেউ পাইকারি ব্যবসায়ী ও ডিলারদের কমিশন বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনা পরিস্থিতি আর খারাপ না হলে শিগগিরই টাইলসের ব্যবসায় প্রবৃদ্ধির ধারা ফিরবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গত কয়েক দিন রাজধানীর হাতিরপুলের টাইলসের দোকানে ঘুরে দেখা যায়, অনেক ক্রেতা ভিড় করছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিক্রি ভালো। অনেক ক্রেতার অভিযোগ, বিশেষ ধরনের টাইলসের জোগান কিছুটা কম। আর দোকানদারেরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় পণ্য কিছুটা কম পাচ্ছি। প্রতিযোগিতা থাকায় তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তাতে লাভ কম হলেও ব্যবসা ভালো।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) তথ্যানুযায়ী, দেশে বার্ষিক ৫ হাজার কোটি টাকার টাইলসের বাজার রয়েছে। তার ৮০ শতাংশের জোগান দেয় দেশীয় ৩০টি প্রতিষ্ঠান। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্থানীয় বাজারে ৩ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকার টাইলস বিক্রি করেছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। রপ্তানিও হয়েছে ৩ কোটি টাকার। তবে আমদানি হয়েছে ৯৩৯ কোটি টাকার টাইলস।
নতুন কোম্পানি হিসেবে টাইলসের বাজারে ভালো ব্যবসা করছে ডিবিএল গ্রুপ। ২০১৭ সালের এপ্রিলে তারা তাদের পণ্য বাজারজাত শুরু করে। ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে গাজীপুরের মাওনায় ৩০ একর জমির ওপর ডিবিএলের কারখানায় বর্তমানে দিনে ৩৫ হাজার বর্গমিটার টাইলস উৎপাদিত হচ্ছে।
করোনাকালে টাইলসের ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিবিএল সিরামিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাইলসের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। করোনাকালে কাঁচামাল আনা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা ক্রমান্বয়ে এ সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, শিগগিরই আমরা প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠব।’
টাইলসের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। করোনাকালে কাঁচামাল আনা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা ক্রমান্বয়ে এ সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এম এ জব্বার, এমডি ডিবিএল সিরামিকস
আবাসন খাতের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান শেল্টেক্। তিন দশকের যাত্রায় অন্য অনেক খাতের ব্যবসায় নিজেদের যুক্ত করেছে তারা। ভোলায় কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে টাইলসের জগতে প্রবেশ করে শেল্টেক্ গ্রুপ। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাদের একটি ইউনিটের উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে তাদের দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ১ লাখ হাজার বর্গফুট টাইলস। শিগগিরই বাকি দুই ইউনিট চালু হলে সেটি বেড়ে হবে ৪ লাখ ৬০ হাজার থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার বর্গফুট।
জানতে চাইলে শেল্টেক্ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, টাইলসের ব্যবসা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। কারণ, সরকারের অনেক প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চলছে। মাঝে আবাসন ব্যবসা চাঙা হতে শুরু করলেও আবার কিছুটা থমকে গেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে সব প্রতিষ্ঠানই বিশেষ ধরনের টাইলস কম উৎপাদন করছে। কারণ সময়টা কঠিন। তবে যেসব টাইলস বেশি চলছে, সেগুলোই উৎপাদনেই মনোযোগ বেশি সবার।
হবিগঞ্জে দেড় লাখ বর্গমিটার আয়তনের কারখানায় ২০১৩ সালে টাইলস উৎপাদন শুরু করে স্টার সিরামিকস। বাংলাদেশ ও লেবাননের যৌথ বিনিয়োগের এই কোম্পানি ২০১৫ সাল থেকে টাইলসের পাশাপাশি স্যানিটারিওয়্যার উৎপাদন করছে। করোনার শুরুতে কিছুদিন কারখানা চালু থাকলেও পরে আড়াই মাস উৎপাদন বন্ধ থাকে। বর্তমানে পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করে টাইলস উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে স্টার সিরামিকসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ মহসিনুল হোসেইন বলেন, ‘বর্তমানে টাইলস বিক্রি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। প্রবৃদ্ধি না হলেও আমাদের বিক্রি গতবারের মতোই। তিনি জানান, বর্তমানে সরকারি প্রকল্পেই বেশি টাইলস বিক্রি হচ্ছে। তবে বেসরকারি প্রকল্পেও গতি এসেছে।’
টাইলসের পাশাপাশি সিরামিক খাতের অন্য দুই পণ্য—স্যানিটারিওয়্যার ও টেবিলওয়্যারের ব্যবসাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে জানালেন বিসিএমইএর সহসভাপতি মঈনুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক ইরফান উদ্দীন। তাঁরা বলেন, দেশে টেবিলওয়্যারের ভালো ব্যবসা হলেও রপ্তানি বাজার কিছুটা শ্লথ।
জানতে চাইলে বিসিএমইএর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে এপ্রিল-মে মাসে বিক্রি ও উৎপাদন—দুটিই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই জায়গা থেকে টাইলসের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বর্তমানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ১৫-২০ শতাংশ ব্যবসা কম হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি আর খারাপ না হলে ব্যবসা দ্রুতই স্বাভাবিক সময়ের অবস্থায় ফিরবে বলে আশা করছি।’
বিসিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, চীন থেকে কাঁচামাল আনতে প্রতি কনটেইনারের ভাড়া ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ডলার। বর্তমানে সেটি বেড়ে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার ডলার হয়ে গেছে। এরপরও কনটেইনার পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক আগে থেকে বুকিং দিতে হচ্ছে।