কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে দেশের ৬৪ জেলায় কৃষকের বাজার স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। এসব বাজারে কৃষক সরাসরি এসে তার নিরাপদ কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবেন। সেজন্য কৃষককে দিতে হবে না কোনো ধরনের টোল। প্রয়োজনে কৃষকের বাড়ি থেকে পণ্য এসব বাজারে নিয়ে আসতে পরিবহন সহায়তা দেবে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদফতর থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে এসব বাজার স্থাপন করে চালু হবে। এরপর হালকা অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। পরবর্তী সময়ে স্থায়ী রূপ পাবে এসব বাজার। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তদারকির মাধ্যমে নিরাপদ সবজিসহ কৃষিপণ্য উৎপাদনে নজর দিচ্ছে সরকার। কৃষকের বাজারে নিরাপদ কৃষিপণ্য বিক্রির বিষয়েও জোর দেয়া হচ্ছে। তারা জানিয়েছেন, সবজি চাষে রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও পোকামাকড় দমনে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। তাছাড়া অতিলাভের আশায় বাজারে বিক্রির জন্য সবজির মাঠে কীটনাশক প্রয়োগ করে অল্প সময়ের মধ্যে সবজি সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে কীটনাশক প্রয়োগ ও প্রয়োগমাত্রা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় নিরাপদ সবজি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তারা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক উপাদান মানুষের দেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির কারণ। জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, সঠিকমাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ, উপযুক্ত সময় ও নির্ধারিত মাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার এবং সঠিক সময়ে সবজি সংগ্রহের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের গুরুত্ব দিনদিন বাড়ছে। তাই বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টির চাহিদা পূরণে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব জেলায় আমরা কৃষকের বাজার করতে চাই। এটা হবে নিরাপদ কৃষিপণ্যের মার্কেট। তবে এটা সোজা নয়, বেশ কঠিন কাজ। মার্কেট করার জন্য জায়গা লাগবে, কে দেবে আমাদের সেই জায়গা? দেখা গেল সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে জায়গা নিলাম, কদিন পর তারা এসে সেখান থেকে টোল আদায় করল। তাহলে সেটা আর ফার্মার্স মার্কেট থাকবে না। তখন সেটা অন্যান্য মার্কেটের মতো হয়ে যাবে। কৃষকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হবে। আমরা এমন কিছু করতে চাই না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই কৃষকদের জন্য একটি মার্কেট। সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমরা বলেছি, সবাই আগ্রহ দেখাচ্ছে। নিরাপদ কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য আমরা প্রত্যেক উপজেলায় দুটি করে গ্রাম নিয়েছি। নিরাপদ সবজি চাষ হচ্ছে কি-না, সেটা কৃষি অফিসার মনিটরিং করে থাকেন। ফসল রোপণ থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত মনিটরিং হয়। মার্কেট করার ক্ষেত্রে আমরা খুব সাবধানে এগোচ্ছি। যাতে আমরা টেকসই একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি।’
‘এই মার্কেটে কৃষক সরাসরি এসে তার পণ্য বিক্রি করবেন। এখন ছোট ছোট হাটে কৃষকরা সরাসরি পণ্য বিক্রি করছেন। কিন্তু জেলা শহরে কৃষককে আড়তে পণ্য ওঠাতে হয়। মুন্সিগঞ্জের আলু প্রথম ঢাকার আড়তে আসে, এরপর আবার মুন্সিগঞ্জে যায়।’ কৃষি সচিব বলেন, ‘সাধারণত কৃষকদের কাছ থেকে পাইকাররা পণ্য নিয়ে যান। কিন্তু কৃষকের বাজার হলে চাষিরা জেলাপর্যায়ে নিজেই পণ্য নিয়ে সরাসরি বিক্রি করতে পারবেন। তাকে কোনো ধরনের টোল দিতে হবে না।’ নাসিরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সেফ ফুড মার্কেট করতে চাচ্ছি এজন্য যে, সবজি সরাসরি এসে আমাদের রান্নাঘরে ঢোকে। আর টমেটোর মতো যদি জিনিস হয় তবে তো রান্নাঘরে ঢোকার আগেই খাবার টেবিলে চলে আসে। সেটা যদি বিষ মাখানো হয় তবে সর্বনাশ, জাতি হিসেবে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ ‘তবে মার্কেট জমানোটাও একটা বিষয়। বিক্রেতা ভাবে ওখানে গেলে আমার জিনিসটা বিক্রি হবে তো? আবার ক্রেতা ভাবে আমরা দরকারি জিনিসটা ওখানে পাব তো? এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছেই। সেচ ভবনে আমরা যে নিরাপদ সবজি বাজার করেছি, সেখানে এটা আমরা ওভারকাম করছি। এখানে কী কী ত্রুটি ছিল তা চিহ্নিত করছি। এভাবে আমরা সারাদেশে মার্কেট গড়ে তুলতে পারব বলে আশা করছি’— বলেন কৃষি সচিব।
কৃষকদের জন্য ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে একটি বাজার করা হবে জানিয়ে নাসিরুজ্জামান বলেন, ‘এই মার্কেটে সবজি, মাছ, গুড়, মধুসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য থাকবে।’ কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আপাতত অস্থায়ীভিত্তিতে ৪৫টি জেলায় কৃষকের বাজার স্থাপন করতে যাচ্ছি। এরপর ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৪ জেলায় হালকা অবকাঠামোসহ কৃষকের বাজার স্থাপন করা হবে। পরবর্তী সময়ে আমরা এর স্থায়ী রূপ দেব। এজন্য ২০০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প নেয়া হবে। এভাবেই আমরা এগোচ্ছি।’ ‘এছাড়া ঢাকায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউকে এফএও-এর (জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা) সহায়তায় কেন্দ্রীয়ভাবে কৃষকের বাজার করব আমরা। এখন যেটি সেচ ভবনের সামনে বসে, সেটি ওখানে স্থানান্তরিত হবে’— বলেন মোহাম্মদ ইউসুফ। মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘এই বাজারে এসে কৃষক তার পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারবেন। ভোক্তা সঠিক দামে নিরাপদ পণ্যটি কিনে নিতে পারবেন। এই উদ্দেশ্যেই কৃষকের বাজার প্রতিষ্ঠা করা হবে।’