স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না কর্মহীন মানুষ, বদলাচ্ছে পেশা

0
414

রাজধানীর মানিকনগর এলাকায় থাকেন জাকির হোসেন (২৮)। আগে কাজ করতেন ঢাকা-বাইপাইল সড়কে চলা লাব্বাইক পরিবহনে। এপ্রিল থেকে টানা জুন পর্যন্ত বেকার ছিলেন। এখন ভ্যানে সবজি বিক্রি করেন। গ্রামে জমি থাকলে সেখানে চলে যেতেন তিনি। কিন্তু সে উপায় না থাকায় ঢাকায় কর্মহীনভাবে যখন পরিবার নিয়ে বাস করা কঠিন হয়ে পড়ছিল তখনই ভ্যানে সবজি বিক্রির চিন্তা মাথায় আসে তার। তবে এই সবজি বিক্রি করেও সংসার চালনো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি। গার্মেন্টস কর্মী রত্নাশীল (২৭) এখন বাসা বাড়িতে কাজ নিয়েছেন। তিনি জানান, মুগধা এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। রোজার ঈদের সময় সেই কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই এখন বাসাবাড়িতে কাজ করছেন। পেশা বদলের তালিকায় এক সময়ে ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পেশাজীবী জানান, সম্প্রতি একটি বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শতাধিক কর্মকর্তা ছাঁটাই করা হয়। সেই ছাঁটাইয়ে তিনিও বাদ পড়েন। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া কিছু অর্থ দিয়ে বর্তমানে তিনি বাচ্চাদের খেলনা, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ‘বেকার হয়ে গ্রামে গিয়ে বসে থাকা অসম্মানের বিষয়। তাছাড়া সন্তানের পড়াশুনাসহ সবকিছু মিলিয়ে আয় ছাড়া ঢাকায় জীবন যাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত এই কাজই করতে হবে।’ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত কাজ হারিয়েছেন এমন অন্তত দশজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকেই এখনও কাজের সুযোগ পাননি। তাদের মধ্যে কেউ ভেবেছিলেন, দুয়েক মাস পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কাজ ফিরে পাবেন। আবার কেউ ভেবেছিলেন, ঈদের পরে নিজের কর্মস্থলে যোগ দিতে পারবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেসব কিছুই হয়নি। ফলে রাজধানীতে কর্মহীন এমন মানুষের জীবন যাপন যখন কঠিন হয়ে পড়ছে, তখন তারা বাধ্য হয়ে পেশা বদলাচ্ছেন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেই সাধারণ ছুটির পাশাপাশি লকডাউন তুলে দিয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরানোর চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু টানা ছেষট্টি দিন সাধারণ ছুটি আর দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা লকডাউনে যেসব স্বল্প আয়ের মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তারা ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে। বিশেষ করে খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষগুলো এখনও চরম কষ্টে দিন পার করছেন। করোনাকালের গত পাঁচ মাসে কোন পেশার কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন সরকারিভাবে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। কিন্তু বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, সেই সংখ্যা কয়েক কোটি। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির গবেষণা অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে এর মধ্যে কাজ হারিয়েছেন ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। আর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষনা (বিআইডিএস) বলছে, আনুষ্ঠানিক খাতে বিভিন্ন অফিসে চাকরি করেন এমন ১৩ ভাগ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। আর ২৫ শতাংশের বেতন কমে গেছে। চাকরি আছে বেতন নাই, এমন পেশাজীবীর সংখ্যা আরও বেশি। অনেক শ্রমজীবী হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন সেক্টর ও কলকারখানায় কাজ করতো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ওইসব ব্যবসায়ীরা লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ফলে এখনও ওই সেক্টরের শ্রমজীবীদের বেশিরভাগ অংশই বেকার। এ প্রসঙ্গে দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দীন বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছোট ব্যবসায়ীরা। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম যে, এইসব ব্যবসায়ীদের জন্য ছোট ছোট ঋণের ব্যবস্থা করতে। আমরা অনুদান চাই না। ঋণ পেলে আমার ইনকাম করে তা পরিশোধ করব।’ ক্ষুদ্র এই ব্যবসায়ীরা সাধারণ ছুটিতে পুঁজিও শেষ করে ফেলছে। ফলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও এরা এখনও ব্যবসা শুরু করতে পারেনি। অর্থনীতিবিদ ড. ফরাসউদ্দীন বলেন, ‘এই পরিস্থিতি শুধু সামাজিক জীবনযাত্রাতেই প্রভাব ফেলছে না, মানসিকভাবেও মানুষদের বিপর্যস্ত করে তুলছে। এই বিশাল সংখ্যক কর্মহীন মানুষ অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। পেশা বদল করে হলেও এদের কাজের ব্যবস্থা করতে সরকার এবং বেসরকারি খাত সংশ্লিষ্টদের ভাবা উচিত। এই অর্থনৈতিক শিকলবন্দি অবস্থা থেকে মানুষদের বের করতে হবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here