বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি ৫ শতাংশ বা তারও বেশি সংকুচিত হতে পারে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, চলতি বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যদিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে সর্বোচ্চ। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (এসএমই) খাতের অবদান অনস্বীকার্য। এসএমই খাতে তুলনামূলক স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগে অধিকসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান হচ্ছে ২৫ শতাংশ। আর সামগ্রিকভাবে শিল্প খাতে এসএমই সেক্টরের অবদান ৩২ শতাংশ। শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের ৮০ শতাংশই হচ্ছে এসএমই খাতে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণজনিত কারণে সবচেয়ে বিপর্যস্ত এসএমই খাতের পুনর্বাসনে সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। ইতিপূর্বে এসএমই খাতের সংজ্ঞায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। আগে কটেজ ও মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজকে এসএমই শিল্পের আওতায় ধরা হতো না। গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারের মাধ্যমে কটেজ ও মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজকে এসএমই খাতের আওতাভুক্ত করে এই খাতের নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (সিএমএসএমই)। ফলে এসএমই খাত অর্থায়ন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যে রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেত কুটির এবং ক্ষুদ্রশিল্পও তা পাবে। একই সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদের এক সভায় এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য বিনা জামানতে ব্যাংক ঋণদানের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। এতে এসএমই খাতের উদ্যোক্তা, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই খাতের উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ফান্ড ক্রাইসিস। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে দেশের বেশির ভাগ এসএমই শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী তিনে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের অভিঘাত বন্ধ বা সীমিত হয়ে এলে অর্থনৈতিক পুনর্বাসনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হবে। বৃহত্ শিল্প-কারখানা তাদের আর্থিক ক্ষতি অল্প দিনের মধ্যেই কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর বিদেশি বায়াররা তৈরি পোশাকসামগ্রী ক্রয়ের জন্য দেওয়া যেসব আদেশ স্থগিত করেছিল, ইতিমধ্যেই তার ৮০ শতাংশ ফিরে এসেছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে এসএমই খাতের উত্পাদন চালু রাখা নিয়ে। ইতিমধ্যেই সরকার করোনা সংক্রমণজনিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ১৮টি সেক্টরের জন্য এই প্যাকেজ দেওয়া হবে। এর মধ্যে বৃহত্ শিল্প-কারখানার জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ৩০০ মিলিয়ন টাকা রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য স্পেশাল ফান্ড হিসেবে ৫০ বিলিয়ন টাকা এবং এসএমই শিল্পের জন্য ২০০ বিলিয়ন টাকা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। কৃষি ভর্তুকির জন্য ৯৫ বিলিয়ন টাকা এবং কৃষি পুনঃ অর্থায়নের জন্য ৫০ বিলিয়ন টাকা আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এসএমই খাতের জন্য যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে তার পরিমাণ আরো বাড়ানো দরকার বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। এ ছাড়া এই অর্থ কীভাবে প্রদান করা হবে সে সম্পর্কেও সুস্পষ্ট নীতি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার করোনা ভাইরাস সংক্রমণজনিত আর্থিক ক্ষতি উত্তরণের জন্য যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে প্রয়োজনের নিরিখে তা আরো বাড়ানো হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কোনো কোনো ইউরোপীয় দেশ তাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বাছাই করে সরাসরি নগদ অর্থ প্রদান করছেন, যাতে তারা সেই অর্থ ব্যবহার করে তাদের আর্থিক দুরবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারেন। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রেও এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। সরকার এসএমই খাতের জন্য আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে তা কীভাবে বিতরণ করা হবে? ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অত্যন্ত উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী। তারা একটু সহায়তা পেলেই আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। এসএমই খাত দেশের উত্পাদন খাত সচল করার পাশাপাশি ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রচলিত পদ্ধতিতে ঢালাওভাবে ঋণ দানের যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা খুব একটা কার্যকর নয়। তাই ঢালাওভাবে ঋণদানের পরিবর্তে উদ্যোক্তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণদান বা অর্থায়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ‘উপযুক্ত ঋণ’ হতে পারে একটি কার্যকর পদ্ধতি। বিষয়টি নিয়ে আলাপ হয় উপযুক্ত ঋণের উদ্ভাবক বা প্রবক্তা পিকেএসএফের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য বিমোচন এবং ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে খুব একটা সহায়ক নয়। এক্ষেত্রে বরং উপযুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। উপযুক্ত ঋণ বলতে এমন ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে একজন উদ্যোক্তার চাহিদা মোতাবেক ঋণ দানের ব্যবস্থা করা হয়। একই সঙ্গে ঋণদানের পাশাপাশি উদ্যোক্তার দক্ষতা উন্নয়ন এবং বাজারজাতকরণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। উদ্যোক্তা ঋণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছেন কি না, তা দেখার জন্য নিবিড়ভাবে মনিটরিং করতে হবে। ঋণের অর্থ পেলেই একজন উদ্যোক্তা তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবেন—এটা নাও হতে পারে। পণ্য উত্পাদনের পাশাপাশি সঠিকভাবে বাজারজাতকরণ করতে না পারলে প্রতিষ্ঠানটি মার খেতে বাধ্য। এই সীমাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য কার্যকর এবং লাগসই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে এই ব্যবস্থা বেশ কার্যকর বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ‘উপযুক্ত ঋণ’ বলতে সেই ঋণদানব্যবস্থাকেই বোঝায়, যেখানে একজন উদ্যোক্তার চাহিদামতো ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়। ঋণ কীভাবে ব্যবহার করে দক্ষতার সঙ্গে পণ্য ও সেবা উত্পাদন এবং সঠিকভাবে বাজারজাতকরণ করতে হয়, এসব বিষয়ে লাগসই প্রশিক্ষণদানের মাধ্যমে একজন উদ্যোক্তার দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়। কোনো একজন উদ্যোক্তাকে যদি তার চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে সেই ঋণের অর্থ অপব্যবহার হওয়ার শঙ্কা থাকে। আবার কাউকে যদি চাহিদার তুলনায় কম পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে তার পক্ষে প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে উদ্যোক্তা বিকল্প কোনো সূত্র থেকে অর্থায়ন সংগ্রহ করতে চাইবেন। এতে তিনি সমস্যায় পতিত হতে পারেন। উপযুক্ত ঋণ হচ্ছে সেই ঋণ, যা একজন উদ্যোক্তার প্রয়োজনমাফিক দেওয়া হয়। যার বেশি অর্থ প্রয়োজন, তাকে বেশি অর্থ দেওয়া হবে আর যার কম অর্থ দরকার, তাকে কম অর্থ দেওয়া হবে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরবর্তী অর্থনৈতিক উত্তরণে এসএমই খাতই হতে পারে কার্যকর বিকল্প উত্স। কাজেই সে কথা মাথায় রেখেই আমাদের আগামীর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সাজাতে হবে। প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে আমাদের কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করে উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করতে হবে।