NewIncredible offer for our exclusive subscribers!Read More
Economy

কর্মহীন পেশাজীবীদের গ্রামে ফেরা ‘ভালো ইঙ্গিত’— মত অর্থনীতিবিদদের

  • July 3, 2020
  • 1 min read
কর্মহীন পেশাজীবীদের গ্রামে ফেরা ‘ভালো ইঙ্গিত’— মত অর্থনীতিবিদদের

করোনাকালে একে তো চাকরি নেই। অন্যদিকে জমানো টাকাও শেষের পথে। আবার নিয়মিত বাড়িভাড়া শোধ করতে না পারায় বকেয়া মিটিয়ে ফ্ল্যাট খালি করার নোটিশও পেয়েছেন কেউ কেউ। যেখানে তিনবেলা স্বাভাবিক খাবারের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে আয়ের বাইরে থেকে হাজার হাজার টাকা খরচ করে ভাড়া বাড়িতে পরিবার নিয়ে বাস করা অনেকের পক্ষেই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রাম ফিরে যাচ্ছেন অনেক পেশাজীবী। তবে অন্যদিকে পেশাজীবীদের এই গ্রামমুখী হওয়াটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, এটা দেশের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে। কারণ বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা যত গ্রামে যাবেন, গ্রাম তত উন্নত হবে।

চাকরি হারিয়ে গ্রামে যাচ্ছেন বা যাবেন- এমন কয়েকজনের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদেরই একজন কমল সরকার (৪৫)। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা কমল সরকারের চাকরি গেছে এপ্রিলে। ভেবেছিলেন লকডাউন উঠে গেলে নতুন কাজ পেয়ে যাবেন। সেই আশায় জমানো টাকা দিয়ে এতদিন কোনো রকমে সংসার চালিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘গত মাসের বাড়ি ভাড়া দিতে পারেননি। একটা ফিক্সড ডিপোজিট ছিল শেষ সম্বল। সেটা তুলে বাড়ি ভাড়া দিয়ে বাকেরগঞ্জ গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছি। এরই মধ্যে মেয়েদের স্কুল শিক্ষকদের ঢাকা ছাড়ার কথা জানিয়ে দিয়েছি।’

মিলন খান (৩৬)। রাজধানীর একটা পাঁচ তারকা হোটেলে কাজ করতেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সাধারণ ছুটি ঘোষণার প্রথম দফায় তাদের সবাইকে ছুটিতে পাঠানো হয়। ৪ এপ্রিল ছুটি শেষ করে কাজে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও সেসহ আরও আটজনকে একসঙ্গে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে মালয়েশিয়া থেকে পড়াশুনা করে এসেছি। এখন অন্য কাজ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই গ্রামে যাওয়ার চিন্তা করছি।

এভাবেই বিনা নোটিশে অনেকের চাকরি চলে যাচ্ছে। এমনকি চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার সময় কোনো নিয়ম-কানুনও মানা হচ্ছে না। একজন পেশাজীবী দীর্ঘদিন যে প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করছেন, সেই তিনি চাকরিচ্যুতির সময় জানতে পারছেনা না কী অপরাধ তার। নিয়ম অনুযায়ী ছাঁটাই করলে যে বাড়তি তিন মাসের টাকা দিতে হয়, সেটাও দেওয়া হচ্ছে না। ফলে উপায় না দেখে অনেকেই বাড়ি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এভাবেই দেশের বহু প্রতিষ্ঠান ব্যয় সংকোচন করতে গিয়ে কর্মী ছাঁটাই করেছেন। তৈরি পোশাক শিল্প শ্রমিক ছাঁটায়ের ঘোষণা দিয়েছে; ব্যাংক খাত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেতন কমিয়েছে। আগামীতে বেশকিছু ছোট ব্যবসাও যে মুখ থুবরে পড়বে, তার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তার ওপর কমেছে সুদের হার। ফলে পেশাজীবীদের জন্য বলতে গেলে কঠিন সময় চলছে। কাজ হারিয়ে ব্যয়বহুল ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরেছেন অনেকে পেশাজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। যদিও এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে এমন খবর প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই গ্রামমুখী হওয়াকে ইতিবাচক দেখছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর অর্থনীতিবিদ ড. ফরাসউদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রামে যেতে হয়তো অনেকে বাধ্য হচ্ছেন। এটা দেশের জন্য, ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে। কারণ বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী লোক যত গ্রামে যাবেন, গ্রাম তত উন্নত হবে। তাছাড়া গ্রামে এখন সুযোগ সুবিধা বেড়েছে। বিজ্ঞজনরা যেখানে যাবেন সেখানে পরিবেশ ভালো হবে।’

‘তবে এমনভাবে কাজ হারিয়ে সহায় সম্বলহীনভাবে মানুষ গ্রামে ছুঁটবে সেটা দৃষ্টিনন্দন নয়। কর্মহীন এই মানুষগুলোর প্রতি সরকারের নজর রয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এদের উচিত ছিল একটা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তাদের সমস্যা তুলে ধরা। সরকারের কাছে তারা বলতে পারতেন, অনুদান চাই না, মূলধন চাই ঘুরে দাঁড়াতে।’- বলেন ড. ফরাসউদ্দীন।

করোনা পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে এই পেশাজীবীদের কদর বাড়বে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেকি এই গভর্নর বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পই ভালোভাবে টিকে থাকবে। আর সেখানে ব্যবসায়ী নয়, পেশাজীবীদের কদর বাড়বে।’

কোভিড-১৯ রুখতে দেশ জুড়ে লকডাউনের সময়ে কতজনের কাজ চলে গেছে, কতজনের বেতন কমে গেছে অর্থাৎ দেশের চাকরির বাজারের বাস্তব চিত্র কেমন সে বিষয়ে সরকারের কোনো পরিসংখ্যান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সমীক্ষা বলছে, লকডাউন ও সাধারন ছুটির ৬৬ দিনে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে। ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের শ্রেণি কাঠামোতে পরিবর্তন হয়েছে। হত দরিদ্রদের তালিকায় নতুন করে ২ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ যোগ হয়েছে। তবে অতি ধনীদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে মনে করে সংগঠনটি।

এদিকে বেসরকারি সংস্থ্যা ব্র্যাকও বলছে, ৯৩ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। আর গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’র (সিপিডি) পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সার্বিকভাবে দারিদ্রের হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০১৯ সালে ২০ শতাংশে নেমেছিল। পাশাপাশি আয় ও ভোগের বৈষম্যও বেড়েছে। সর্বোপরি করোনাভাইরাসের থাবায় সামগ্রিক অর্থনীতিতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

এদিকে পিছিয়ে পড়া অর্থনীতিকে টেনে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭২ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। তবে এই প্রণোদনা কেবল বড় ব্যবসায়ী এবং হত দরিদ্র অসহায় কর্মহীনদের জন্য। সেখানে পেশাজীবীদের জন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পেশাজীবীদের বাদ দিয়ে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ সিপিডির গবেষক ও পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু সমস্যাটা দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং এসব জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের এখন পর্যন্ত সুর্নিদিষ্ট কোনো উদ্যোগ নেই। তাই তাদের সংকট তীব্র হচ্ছে। অনেকে গ্রামে যাচ্ছেন। এটা খারাপ নয়, ইতিবাচক দিক। তবে তারা সেখানে যাতে টিকতে পারে, যেমন- কৃষি কিংবা অকৃষি খাত হোক; যাতে কাজে জড়িত হতে পারে সে ব্যবস্থা সরকার করা উচিত। সেখানে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা কিংবা কেউ যদি পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় যেতে চায় তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সেটা স্থানীয়ভাবেও ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘যারা কিছুটা শিক্ষিত তারা হয়তো অনলাইনভিত্তিক পেশায় জড়িত হতে পারবেন। সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ সহজলভ্য করে দেওয়া যেতে পারে। এই জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন কাজের ব্যবস্থা করা। তাদের নগদ অর্থ দিয়ে খুব বেশি সুবিধা করা যাবে না। কারণ তাদের চাহিদা বড়। আর এই চাহিদা সরকারও প্রাথমিকভাবে মেটাতে পারবে না। সুতরাং তারা যাতে পেশা পরিবর্তন করেও ছোটখাটো কাজ করে হলেও টিকে থাকতে পারেন সেই ব্যবস্থা সরকারের করা উচিত।’

উল্লেখ্য, ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ২৬ মার্চ থেকে দফায় দফায় ৩০ মে পর্যন্ত ৬৬ দিন দেশজুড়ে লকডাউন এবং সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে ৩১ মে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে অফিস, ব্যবসা, বাণিজ্য খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু লকডাউনেই অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটায় করতে থাকে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আবার বেতনও কমিয়ে দিচ্ছে। আর এই পরিস্থিতিতে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য করতে না পেরে গ্রামের পথে হাঁটছে অনেকেই।

About Author

Business Bangladesh

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.