করোনা সংক্রমণে বিশ্ববাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অনেক দেশ জীবনযাত্রার স্বাভাবিক ধারা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি সফল হচ্ছে না। কবে এ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, তা অজানা। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করে আমাদের দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। করোনাকালীন সংকটে দেশের অর্থনীতি গতিশীলে দেশি শিল্পই ভরসা। তাই আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে দেশি শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে একগুচ্ছ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। শিল্প খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করেছেন, এসব সুবিধা বাস্তবায়ন করা হলে করোনায় লোকসানে পড়া অর্থনীতি আবারও লাভজনক হবে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন দেশে করোনার কারণে লকডাউন চলছে। অনেক দেশ থেকে চাহিদামতো কাঁচামাল আমদানি করা সম্ভব হবে না। শুধু কাঁচামাল নয়, ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্যও বিদেশ থেকে আনা যাবে না। অন্যদিকে করোনার কারণে রপ্তানিতে ধস নেমেছে। করোনাকালীন সংকটে আমদানি-রপ্তানির বিকল্প হিসেবে দেশি শিল্পের নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। এবারের বাজেট প্রস্তাবে সরকার এ সত্য উপলদ্ধি করে দেশি শিল্প লাভজনক করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করি, এতে সুফল আসবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনার কারণে দেশি শিল্প খাতে ধস নেমেছে। এবারের বাজেট প্রস্তাবে এসব শিল্প খাত চাঙ্গা করতে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আবার পুরনো সুবিধাগুলোও বহাল রেখেছে। কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ শিল্প হলো একটি অর্থনীতির প্রাণ। প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করতেই হবে। এখন দেখা যাক করোনা সংকটে তা কতখানি কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেন, করোনার কারণে ২০২০ সালে বিশ্ববাণিজ্য হ্রাসের পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। ফলে বাংলাদেশেও তৈরি পোশাকসহ সার্বিক রপ্তানি ক্রমাগত হ্রাস পেতে পারে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে সামনের দিনগুলোতে রপ্তানি আরো কমবে। করোনার প্রভাব মোকাবেলায় চলমান সব সুবিধা বহাল রাখা এবং নতুন সুবিধা দেওয়া হবে।
রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্পে করোনাকালীন সংকট মোকাবেলায় চলমান অন্যান্য সুবিধার সঙ্গে আগামী অর্থবছরের জন্য ১ শতাংশ হারে অতিরিক্ত রপ্তানি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। আগামীতে গ্রিন বিল্ডিং সাটিফিকেশন আছে এমন প্রতিষ্ঠানের করহারে ছাড় দিয়ে ১০ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে উৎসে কর কর্তনের হার ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫ শতাংশ নির্ধারণের বলা হয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান এনভয় গ্রপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম মুর্শেদী কালের কণ্ঠকে বলেন, তৈরি পোশাক শিল্প লোকসানে পড়লে দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়বে। তাই তৈরি পোশাক খাত টিকিয়ে রাখতে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। বাজেট প্রস্তাবে নেওয়া পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে করোনার কারণে এ খাতে সৃষ্ট মন্দা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে। করোনার কারণে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে। এতে অনেক কাঁচামালের দাম বেড়েছে। বাজেট প্রস্তাবে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কছাড় দেওয়ায় শিল্পে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আগামী অর্থবছরে কাগজ, ইস্পাত, প্লাস্টিক ও প্যাকেজিং শিল্পের বিকাশে কাঁচামালের আমদানিতে শুল্কহার হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামীবারের জন্য বাজেট প্রস্তাবে স্থানীয় শিল্পের আমদানি পর্যায়ে শিল্পের কাঁচামালের ওপর আগাম কর হ্রাস করে ৪ শতাংশের প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের রেয়াত গ্রহণের সময়সীমা বাড়িয়ে চার করমেয়াদ করা হয়েছে। পরিবহন সেবার ৮০ শতাংশ রেয়াতযোগ্য করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের ভ্যাট রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। আসছে বাজেটেও সরকারের অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভারী প্রকৌশল শিল্প, রপ্তানি খাতের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং দেশীয় শিল্পের বিকাশের জন্য অটোমোবাইল, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার শিল্পসহ কিছু শিল্প খাতে বিদ্যমান মূসক ও সম্পূরক শুল্কের অব্যাহতি বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল-টেলিফোন সেট উৎপাদনের ওপর মূসক অব্যাহতি এবং সংযোজন খাতে ৫ শতাংশ হারে মূসক রাখা হয়েছে।
সাবেক এনবিআর চেয়াম্যান আবদুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, মোবাইল ফোনসেট, অটোমোবাইল, রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনের চাহিদা রয়েছে। এসব শিল্পের সব সুবিধা আগামী বাজেট প্রস্তাবে বহাল রাখা হয়েছে। এসব সুবিধা কাজে লাগাতে পারলে সংশ্লিষ্ট খাতে গতি আসবে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
বর্তমানে দেশে ৭৮ লাখ ১৩ হাজার ৩১৫টি এসএমই শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। জিডিপিতে এসব প্রতিষ্ঠানের অবদান ২৫ শতাংশ। এসএমই খাতের অবদান ৩২ শতাংশে উন্নীত করতে আগামী অর্থবছরে সারা দেশে ১৭৭টি ক্লাস্টারভিত্তিক এসএমই উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের উদ্যোগ চলমান রাখা হবে। করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত কুটিরশিল্পসহ সব এসএমই প্রতিষ্ঠানের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার দুটি আলাদা স্বল্প সুদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধাও আগামীতে চালু রাখা হবে। বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, করোনা সংকটে রপ্তানি বাণিজ্যে গতিশীলতা আনতে ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করতে রপ্তানি সম্ভাবনাময় পণ্যকে চিহ্নিত করা হবে। এর মধ্যে জাহাজ, ওষুধ, ফার্নিচার, বহুমুখী পাটপণ্য, ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড হোম অ্যাপায়েন্স, অ্যাগ্রোপ্রসেসসামগ্রী, কাগজ, প্রিন্টেড ও প্যাকেজিং সামগ্রী, আইসিটি, রাবার, পাদুকা, কাট, পলিশড ডায়মন্ডসহ সম্ভাবনাময় অন্যান খাতকে প্রয়োজনমতো বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে।