প্রয়োজন সাহসী কিছু সিদ্ধান্ত

0
206

চলমান অর্থনৈতিক সংকটের চটজলদি কোনো সমাধান নেই। আমাদের দরকার দুই বছরমেয়াদি একটি ‘অর্থনীতি পুনরুদ্ধার’ পরিকল্পনা, যার অধীনে আগামী দুই অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়ন প্রয়োজন। প্রয়োজন, এই ‘অর্থনীতি পুনরুদ্ধার’ পরিকল্পনার অধীনে সাহসী কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তার বাস্তবায়ন, যাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত স্বাভাবিক গতিধারায় ফিরে আসতে পারে। অবশ্যই দরকার বাণিজ্য, কর-কাঠামো এবং ব্যাংকিং খাতসহ কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কার্যকরী সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা।

আমরা একটি সংকটকালীন সময় অতিবাহিত করছি। এ কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হলে চলবে না। এখানে কয়েকটি খাত সুনির্দিষ্টভাবে অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। আগামী অর্থবছরের বাজেট হওয়া উচিত অবশ্যই একটি ‘কভিড-১৯’ সংবেদনশীল বাজেট। এই বাজেটে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য, কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষা খাতের জন্য উচ্চতর বরাদ্দ এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ এবং প্রণোদনা প্যাকেজের যথাযথ বাস্তবায়ন দরকার।

পাশাপাশি মাথায় রাখতে হবে, এ বছর এবং আগামী অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ অনেক কমে যাবে। ফলে বাজেটের অর্থায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে। তাই সরকারের যে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় খরচ আছে, বিভিন্ন উন্নয়ন বাজেটে যেসব অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প আছে সেগুলোকে অবিলম্বে স্থগিত বা বাতিল করা দরকার। এর পাশাপাশি প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সংস্থা- যেমন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া। এমন একটি সংকটের সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করতে পারে যে, কীভাবে স্বল্প সুদে ও সহজশর্তে ঋণ পাওয়া যায়। সামনের দুটি অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বাজেট ঘাটতি ৭ থেকে ৮ শতাংশে দাঁড়ালেও ক্ষতি নেই।

স্বাস্থ্য খাতে যে দৈন্যদশা তা কিন্তু এই ক্রান্তিকালে আমরা টের পাচ্ছি। করোনাভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে এত বড় একটি সংকট, তা মোকাবিলা করার জন্য আমাদের সরকারি স্বাস্থ্যসেবার যে প্রস্তুতি, সেখানেও আমরা শুরু থেকেই বড় ধরনের দুর্বলতা দেখেছি। যদিও পরবর্তীকালে নানাভাবে বেশকিছু চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু এখনও আমরা অনেক দিক থেকে পিছিয়ে আছি। বাংলাদেশে জিডিপির অনুপাতে ০.৫ থেকে ০.৬ শতাংশ খরচ করা হয় সরকারি স্বাস্থ্যসেবায়। স্বাস্থ্য খাতে এত কম সরকারি খরচ করে করোনাভাইরাসের মতো একটি সংক্রমণ এবং এর ফলে আমরা স্বাস্থ্যসেবার যে সংকট দেখছি, তা মোকাবিলা করা খুবই কঠিন। এবারের বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা এই দিকে খেয়াল করে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনেক বেশি বরাদ্দ দেওয়া হবে। কিন্তু তথ্যউপাত্ত যতটুকু আমরা শুনছি, তাতে আমরা খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছি না। এবারের বাজেটে গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের বরাদ্দ না দেওয়া হলে যে বিপদটি হবে তা হলো, সংক্রমণ এখন যে হারে বাড়ছে এবং সামনে মাত্রা বৃদ্ধির কারণে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর যে বিশাল চাপ আসবে, আমরা যদি দ্রুত আমাদের সক্ষমতা সেভাবে বাড়াতে না পারি, তাহলে এই সংকট মোকাবিলা করা খুবই কঠিন হয়ে যাবে। সরকার বেশকিছু চিকিৎসক ও নার্সকে নিয়োগ দেওয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু পাশাপাশি একটি জিনিস খেয়াল করতে হবে যে, আমাদের মেডিকেল ইকুইপমেন্টস, হসপিটাল ফ্যাসিলিটিজ; অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতের যে অবকাঠামো সেখানে বড় ধরনের উন্নতি দরকার। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, এমন একটি সংকট মোকাবিলা করার সময় বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার দায়বদ্ধতার জায়গাটি খুবই দুর্বল। সুতরাং, এই সংকট মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত সরকারি স্বাস্থ্যসেবাটিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি বিষয় হলো, স্বাস্থ্য খাতে নানা ধরনের খরচের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, সেখানে জবাবদিহি বা দায়বদ্ধতার বাইরে গিয়ে খরচ করা হয়। এটি আমাদের স্বাস্থ্য খাতে যে বড় ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও দুর্নীতি আছে, তারই বহিঃপ্রকাশ। এই দুর্যোগের সময়ে এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠাও জরুরি।

এবারের বাজেটে কৃষিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। তার একটি বড় কারণ, এখন যে সংকট চলছে সেই সংকটে সামনের দিনগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তায় একটি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। খাদ্য নিরাপত্তার সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক সংকটের দিকে যেতে পারে। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় কৃষকদের ৪ শতাংশ সুদে যে ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, আমরা সানেমের পক্ষ থেকে দাবি করেছিলাম যে, এটিকে শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনা হোক। একই সঙ্গে এটি নিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রকৃত কৃষকরা এই ঋণের সুবিধা পান। কৃষিপণ্য ও কৃষি উপকরণের বাজারব্যবস্থা এখন একটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যাকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কৃষি শ্রমিকরা কৃষির বিভিন্ন খাত এবং উপখাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে কাজ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এবারের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক বাড়ানো প্রয়োজন। সানেমের গবেষণায় এটি উঠে এসেছে যে, এই দুর্যোগের কারণে একটি বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়তে যাচ্ছে। যারা আসলে দরিদ্র ছিল না, তারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এই দুর্যোগের সময়ে এ রকম একটি বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দুই ধরনের সহযোগিতা অবশ্যই দিতে হবে। নগদ সহযোগিতা যেমন দিতে হবে, পাশাপাশি খাদ্য সহযোগিতাও দিতে হবে। অনেক জায়গায় এখনও বাজার ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু করা যায়নি এবং অনেক পরিবার খাদ্য সংকটেরও সম্মুখীন হচ্ছে। সুতরাং, সামাজিক সুরক্ষা খাতে আগামী বাজেটে বরাদ্দ যথেষ্ট পরিমাণে বাড়ানো দরকার এবং এই বরাদ্দের প্রকৃত বাস্তবায়ন করতে হবে। যতটুকু সম্ভব দুর্নীতিমুক্ত করে, অনিয়ম রোধ করে এই বিপদকালীন সময়ে এ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এবং নতুন করে যারা দরিদ্র হয়েছে সে জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে হবে।

এবারের বাজেটে মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করার প্রয়োজন রয়েছে। কিছু প্রকল্প যেমন দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, তেমনি এটিও বিবেচনা করা যেতে পারে যে, কিছু মেগা প্রকল্পের জন্য আমরা আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারি কিনা। এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের সামনে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে হয়তো একটি বড় ধরনের সুযোগ আসতে পারে। বিশেষ করে চীন থেকে যদি অন্য দেশে বিনিয়োগ সরে যায় সেখানে বাংলাদেশের সামনে এই বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সুযোগ আসতে পারে। তবে অবকাঠামো ও ব্যবসার পরিবেশের দিক থেকে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য স্পেশাল ইকোনমিক জোনের দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন খুবই সম্পর্কিত। সেদিক থেকে কয়েকটি ক্রিটিক্যাল মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা যেতে পারে।

গতানুগতিকভাবে অন্যান্য বছর যেভাবে বাজেট তৈরি করা হয় এবং বাজেটে অগ্রাধিকারগণ্য খাত (স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, সামাজিক সুরক্ষা) যেভাবে বছরের পর বছর অবহেলিত থাকে এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সক্ষমতার যে ঘাটতি দেখা যায়, সময়ের দাবি সেই মানসিকতা এবং দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here