ব্যবসায়ীদের জন্য সুখবর থাকছে

0
364

নভেল করোনাভাইরাস অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশ ওলটপালট করে দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিশাল ক্ষতির মুখে। পথে বসার অবস্থা হয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর। অনেক প্রতিষ্ঠানেই চলছে নীরবে কর্মী ছাঁটাই। বিনিয়োগ আসছে না। এসব কারণে প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়বে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করতে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের নতুন বাজেটে আসছে একগুচ্ছ সুখবর। এ ক্ষেত্রে করপোরেট কর কমানো, বিনিয়োগ চাঙ্গা করা, রপ্তানিতে প্রণোদনা, আমদানি শুল্ক ছাড়সহ নানা সুবিধা রাখা হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’ শিরোনামে বাজেট উপস্থাপন করবেন। বাজেট বক্তৃতায় এসব বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরবেন তিনি। এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, বিনিয়োগ তথা ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করতে যা যা প্রয়োজন সরকার তার সবই করবে। এ জন্য বেশ কিছু সুবিধা দেওয়া হতে পারে আগামী বাজেটে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। তবে শুধু প্রণোদনা দিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো যায় না। বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়। তিনি বলেন, আমাদের করপোরেট করহার অনেক বেশি। পুঁজিবাজারে অতালিকাভুক্ত কম্পানির করহার অনেক বেশি আছে। এটি কমানো যেতে পারে। তবে করপোরেট কর কমালেই হবে না—অবকাঠামো উন্নয়ন, সুশাসন নিশ্চিত এবং ‘ইজ অব ডুয়িং’ বিজনেসে ভালো করতে হবে। সূত্র মতে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যবসায়ীদের ওপর করের বোঝা বাড়বে না। শুল্ক ও ভ্যাট খাতেও খুব বেশি পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। ব্যবসার স্বার্থে প্রধান প্রধান খাতগুলোতে থাকবে নানা ছাড়। তবে বিলাসবহুল পণ্যগুলোতে শুল্ক বাড়ানো হতে পারে।

আয়করে ছাড় ও করপোরেট কর কমছে : ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরেই করপোরেট কর কমানোর দাবি করে আসছেন। কিন্তু করপোরেট হারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। সাধারণত বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য করপোরেট কর কমানো হয়। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে চাপ পড়বে এ অজুহাতে করপোরেট কর কমানোর পক্ষে নয়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী ভিয়েতনামে করপোরেট কর ২০ শতাংশ। দেশটি বিশেষ বিনিয়োগ প্রকল্পেও বিশেষ ছাড় দেয়। এ ছাড়া থাইল্যান্ডে করপোরেট কর ২০ শতাংশ, মিয়ানমারে ২৫ শতাংশ। গত তিন দশকে মধ্যম আয়ের দেশগুলো গড় করপোরেট করহার ৪০ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। অন্যদিকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েও বাংলাদেশ গত দেড় দশকে করপোরেট কর কমিয়েছে মাত্র আড়াই শতাংশ। এবার নতুন বাজেটে করপোরেট করে কিছুটা পরিবর্তন আসছে।

বর্তমানে করপোরেট করের কয়েকটি স্তর আছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানির করহার ২৫ শতাংশ। আর তালিকাবহির্ভূত বা সাধারণ কম্পানির করহার ৩৫ শতাংশ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করহার ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর তালিকাবহির্ভূত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করহার ৪০ শতাংশ। মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। সিগারেট কম্পানির করহার ৪৫ শতাংশ। মোবাইল অপারেটরে ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর বিদ্যমান রয়েছে। এ ছাড়া পোশাক খাতে করপোরেট কর ১০-১২ শতাংশ। বস্ত্র খাতে করপোরেট কর ১৫ শতাংশ, পাটকলে ১০ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু দুটি স্তরে পরিবর্তন আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কম্পানির করহার কিছুটা কমতে পারে। বর্তমানে এ করহার ৩৫ শতাংশ। নতুন বাজেটে তা ৩২ শতাংশ করা হতে পারে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে করপোরেট করহার কিছুটা কমতে পারে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে করপোরেট কর ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আগামীতে এটি ৩৫ শতাংশ করা হতে পারে। এ ছাড়া নতুন বাজেটে আয়করে ছাড় আসতে পারে। বর্তমানে সর্বনিম্ন করহার ১০ শতাংশ। এটি কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে।

বিনিয়োগ বাড়াতে বিভিন্ন ছাড় : করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরো নাজুক। তাই বাজেটে বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ও অঞ্চলে বিনিয়োগে কর ছাড় দেওয়া হবে। বর্তমানে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগে কর ছাড় রয়েছে। আগামী বাজেটেও তা অব্যাহত থাকবে। বর্তমানে শিল্প ও ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। বিদ্যমান করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যায়। আবাসন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে এ সুযোগ নেওয়া যায়। আসন্ন বাজেটে ক্ষেত্রবিশেষে জরিমানা উঠিয়ে দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শুধু ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে। এনবিআর আর কোনো প্রশ্ন করবে না। আগামী দুই বছরের জন্য এ সুযোগ দেওয়া হতে পারে। পুঁজিবাজারসহ কয়েকটি খাতে এ সুযোগ দেওয়া হতে পারে। মূলত বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যই এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে স্পর্শকাতর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রপ্তানি খাতে বিশেষ ছাড় : চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৪ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে এবার ১০ বিলিয়ন ডলার বেশি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত বছর রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০.৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতেই হয়েছে ১১.৪৯ শতাংশ। করোনাভাইরাসের প্রভাবে রপ্তানি খাত বিশাল ধাক্কা খেয়েছে। রপ্তানির অন্যতম স্তম্ভ তৈরি পোশাক খাতের অর্ধেকের বেশি কারখানা লে-অফ হয়ে গেছে। আগামী মাস থেকে কর্মী ছাঁটাইয়ের শঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে গার্মেন্ট সেক্টরে চার ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়ে থাকে। এটি যথাক্রমে—চার, চার এবং দুই শতাংশ। ইউরোপ ও আমেরিকায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। এটি বাড়িয়ে ২ শতাংশ করা হতে পারে। আগামী বাজেটে ওষুধ খাতেও রপ্তানি প্রণোদনা বাড়ানো হতে পারে। বর্তমানে ওষুধ খাত ১০ শতাংশ হারে প্রণোদনা পায়। আগামী বাজেটে এটি বাড়িয়ে ১১-১২ শতাংশ করা হতে পারে। মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি এবং অপারেশনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ওষুধ খাতের মতোই প্রণোদনা পাবে। এ ছাড়া চামড়া, পাদুকা, পাটসহ অন্যান্য শিল্পও একই ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাই রপ্তানি খাতে বিশেষ ছাড় দেওয়া হতে পারে। তবে ঢালাওভাবে রপ্তানিতে ছাড় দেওয়া হবে না বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাতে নানা কর ছাড় থাকবে। পাশাপাশি রপ্তানি খাত চাঙ্গা করার জন্য এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ানো হবে আগামী বাজেটে। রপ্তানি খাতে ভর্তুকি দেওয়া হবে ছয় হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। বর্তমানে বিভিন্ন পণ্যে রপ্তানি প্রণোদনা দেওয়া হয়। আগামী বাজেটে প্রণোদনা পাওয়া পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো হবে।

আমদানি শুল্কে ছাড় আসছে : করোনাভাইরাসের কারণে আমদানিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে তাই গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পণ্য ও কাঁচামালে কর ছাড় থাকবে। মানুষের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী আমদানিতে আমদানি শুল্ক ও অগ্রিম কর বা অ্যাডভান্স ট্যাক্স অব্যাহতির ঘোষণা থাকবে। পাশাপাশি দেশে করোনাভাইরাসে সুরক্ষা দেয় এমন সামগ্রী তৈরি করলে এতে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে। এ ছাড়া আবাসন ও নির্মাণশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানিতে ছাড় আসতে পারে। বিশেষ করে অগ্রাধিকারভিত্তিক বড় বড় প্রকল্পে যেসব পণ্য ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে ছাড় দেওয়া হতে পারে। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনায় এ চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সরকার চাইছে করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বড় বড় যেসব প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে বা মধ্যবর্তী অবস্থায় রয়েছে, সেগুলো দ্রুত শেষ করতে। কারণ, প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে যত দেরি হবে তত ব্যয় বাড়বে।

দ্বৈত কর পরিহার করা হতে পারে : আগামী অর্থবছরের বাজেটে কিছু ক্ষেত্রে ট্যাক্স অন ট্যাক্স কমানো বা দ্বৈত কর কমানো হতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপে ২০১০ সালে নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা হয়। যা ২০১২ সালে জাতীয় সংসদে পাস হয়। এরপর কয়েক দফা প্রচেষ্টা নেওয়া হয় নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে। কিন্তু নানা কারণে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। সব শেষে চলতি অর্থবছরে আংশিক বাস্তবায়ন করা হয়। ফলে যেভাবে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা হয়েছে তাতে অনেক ক্ষেত্রেই করের ওপর কর বা ট্যাক্স অন ট্যাক্স বসানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আমদানি শুল্কের পাশাপাশি অগ্রিম আয়কর বা অ্যাডভান্সড ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া পণ্য বিক্রির সময়ও রয়েছে পৃথক ট্যাক্স। বিষয়গুলো নিয়ে ব্যবসায়ীরা অসন্তুষ্ট ছিলেন। আগামী বাজেটে ট্যাক্স অন ট্যাক্স কমানো যায় কি না তা নিয়ে কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here