অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেই দরকার মনোযোগ

0
260

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্ব টালমাটাল। নিজ নিজ দেশের জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে দেশে দেশে অবরুদ্ধ অবস্থা বা লকডাউন চলছে। কোথাও শিথিল করা হয়েছে। বাংলাদেশেও দুই মাসের বেশি সাধারণ ছুটির আদলে অবরুদ্ধ অবস্থা চলেছে। এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনীতির দুয়ারগুলো খোলা শুরু হয়েছে।

গত দুই মাসের সাধারণ ছুটির মধ্যে প্রথম এক মাস জরুরি সেবা ছাড়া প্রায় সবকিছুই বন্ধ ছিল। দ্বিতীয় মাস থেকে কিছু খাতের কারখানা খোলা শুরু হয়েছে। এই দুই মাসে বেকার হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষ। অর্থনীতির বড় শক্তি রপ্তানি আয় ব্যাপক কমেছে। আবার প্রবাসী আয়েও ভাটা। অভ্যন্তরীণ চাহিদাও নিত্যপণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে—সেটাই স্বাভাবিক। তবে কতটা পড়বে, তা নিয়ে চলছে হিসাবনিকাশ। সার্বিকভাবে, দেশের অর্থনীতি একটি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে। সব কটি সংস্থাই বলছে, এবার প্রবৃদ্ধি বেশ কমে যাবে। করোনার ক্ষত কতটা গভীর হবে, এর ওপর নির্ভর করছে প্রবৃদ্ধির সব হিসাবনিকাশ। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এখন প্রবৃদ্ধির হিসাবকে বাদ দিয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। করোনার কারণে গত কয়েক বছরে অর্জিত ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির উচ্ছ্বাস মিলিয়ে যাবে।

  • বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
  • এডিবি বলছে, করোনার কারণে বাংলাদেশের জিডিপির দশমিক ২ শতাংশ থেকে দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষতি হতে পারে। অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
  • আইএমএফ বলছে, ২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশে নেমে আসবে।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এই মুহূর্তে প্রবৃদ্ধি নিয়ে বেশি চিন্তা না করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সঠিকভাবে হলে বিপুল মানুষের আবার কর্মসংস্থান হবে। ভোগের চাহিদা বাড়বে। অর্থনীতি চাঙা হবে। তাঁর মতে, ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির চাঙাভাব নিকট-ভবিষ্যতে আর থাকবে না।

কার কত পূর্বাভাস

গত ১২ এপ্রিল প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। করোনা পরিস্থিতি কতটা দীর্ঘায়িত হবে, এর ওপর নির্ভর করবে প্রবৃদ্ধি কত হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দুই মাস স্থবির থাকলে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এই স্থবিরতা চার মাসব্যাপী হলে প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশে নেমে যেতে পারে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে পড়বে। উৎপাদন খাত বিশেষ করে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকের চাহিদা বিশ্বব্যাপী কমে যাবে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খাতের পণ্যের চাহিদাও কমবে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ঝুঁকি তৈরি করবে। নগর দারিদ্র্য বাড়বে। আবার পল্লি এলাকায় গরিবের সংখ্যাও বাড়বে। এমন অবস্থায় কোভিড ১৯-এর ঝুঁকি কমানো এবং আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতার ঝুঁকি কমাতে অর্থনীতিতে মধ্যমেয়াদি পুনরুদ্ধার কর্মসূচি নেওয়ার সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক।

আইএমএফ বলছে, ২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশে নেমে আসবে। গত ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত আইএমএফের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক ২০২০, দি গ্রেট লকডাউন’ প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তবে ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধি বেড়ে সাড়ে ৯ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করে আইএমএফ। এ জন্য করোনাভাইরাসের বিস্তার কমে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি ফিরে আসতে হবে। তারা আরও বলছে, করোনা মহামারির কারণে বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে। ফলে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে আইসোলেশন, লকডাউন করতে হচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যদি চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এই ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক হয়, তবে আগামী বছর প্রবৃদ্ধি বাড়বে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, করোনার কারণে বাংলাদেশের জিডিপির দশমিক ২ শতাংশ থেকে দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষতি হতে পারে। কোভিড সম্পর্কিত বাংলাদেশের একটি প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন করে এডিবি বলেছে, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির কারণে ১৪ লাখ থেকে ৩৭ লাখ মানুষ বেকার হতে পারেন। অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। দি ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট মনে করে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে নেমে আসতে পারে। সব আন্তর্জাতিক সংস্থা অর্থবছরের হিসাবে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে।

সরকারিভাবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রবৃদ্ধির হিসাব করে থাকে। অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই ছয়-সাত মাসের হিসাব ধরে প্রতিবছর একটি সাময়িক হিসাব প্রকাশ করা হয়। এবার এখন পর্যন্ত সেই সাময়িক হিসাব চূড়ান্ত করতে পারেনি বিবিএস। তবে বিবিএসের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এবার সাময়িক হিসাবের যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে, তাতে সাড়ে ৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অবশ্য এপ্রিল মাসেই বলেছেন, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই ৬ শতাংশের কম হবে না। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, করোনার প্রভাবের আগেই অর্থবছরের আট মাস পেরিয়ে গেছে। করোনার কারণে যদি বাকি সময়ে যদি প্রবৃদ্ধি ‘শূন্য’ বা নেতিবাচকও হয়, তবু তা ৬ শতাংশের নিচে হবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here