পশ্চিমেই নির্ভর করছে চীনা অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

0
306

চীনের নেতারা ভেবেছিলেন, ২০২০ সালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশটিতে উদযাপনের উপলক্ষ তৈরি করতে যাচ্ছে। পূর্বাভাস ছিল, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জন হলেই দেশটির অর্থনীতির ব্যাপ্তি এক দশকের মধ্যে বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার মাইলফলক অর্জন করবে। কিন্তু এ পূর্বাভাসকেই পুরোপুরি অকার্যকর করে দিয়েছে নভেল করোনাভাইরাস।

কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ধারণার চেয়ে তাড়াতাড়ি মহামারী নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে বেইজিং। যদিও এর মাত্রা এবং সংক্রমণের গতি অচল করে ফেলেছে গোটা চীনা সমাজকেই। দেশজুড়ে লকডাউনের মাধ্যমে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতেই মহামারী ছড়িয়ে পড়ার গতি কমিয়ে আনতে পেরেছে চীন। সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে সফরের মাধ্যমে গত ১০ মার্চ এ বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ১৯ মার্চের মধ্যে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ নেমে এসেছে শূন্যে। অন্য যারা নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা সবাই আসলে বিদেশফেরত। ইউরোপ এবং দ্রুত সংক্রমণের মাধ্যমে মহামারীর নতুন কেন্দ্রস্থলে রূপ নিতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনকেই বেশি নিরাপদ মনে করেছিলেন তারা।

ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চীনের অর্থনীতি। এমনকি বড় ধরনের আর্থিক সহায়তার পরও এ অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। কারণ সামনের দিনগুলোয় চীনের উত্পাদনশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা পুনরুদ্ধারও জরুরি, যার সম্ভাবনা আপাতত নেই। চীনের সম্প্রতি প্রকাশিত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাজার পর্যবেক্ষকরা যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, এ সময় সব সূচকেই তার চেয়েও দুর্বল অবস্থানে ছিল দেশটির অর্থনীতি। এ দুই মাসে দেশটিতে খুচরা বিক্রি কমেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ২০ শতাংশ। শিল্পোত্পাদন কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশ।

দীর্ঘ সময় ঘরে আটকে রাখার কারণে দেশটির শ্রমিকরা কাজে যেতে পারেননি। অন্যদিকে শ্রমিক ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে কারখানাগুলোও এখন তাদের পূর্ণ সক্ষমতা ফিরে পেতে গলদঘর্ম হচ্ছে। বিশ্লেষকরা এরই মধ্যে চীনা অর্থনীতি নিয়ে তাদের পূর্বাভাস সংশোধন করে কমিয়ে আনছেন। একই সঙ্গে বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশটির অর্থনীতি যে ইতিহাসের বৃহত্তম সংকোচনের মধ্য দিয়ে যাবে, সে বিষয়েও এক রকম নিশ্চিত তারা। চলতি বছরে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬ শতাংশ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় ধরনের আর্থিক প্রণোদনা ও সুদহার কর্তনের পরও দেশটির চলতি বছরের প্রবৃদ্ধি ১ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে থাকবে বলে মনে করছেন তারা।

অথচ ২০০২-০৩ সালেও সার্স ভাইরাসজনিত ক্ষতি থেকে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছিল চীন। সে সময় পশ্চিমের শক্তিশালী ভোক্তা চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে স্বল্পমেয়াদি ক্ষতির গোটাটাই পুষিয়ে নিয়েছিল দেশটি। অন্যদিকে ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দা চীনে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। বৈশ্বিক উত্পাদন ও সরবরাহ নেটওয়ার্ক সচল থাকায় ওই সময় দ্রুত প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম হয় দেশটি।

চীনের অর্থনীতি এখন ধীরে ধীরে সচল হয়ে উঠছে। কিন্তু ইউরোপের বড় অর্থনীতিগুলো এখন বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে অভূতপূর্ব এক আর্থিক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পথে যুক্তরাষ্ট্র। সে হিসেবে বলা চলে, পশ্চিমে যথেষ্ট ক্রেতা খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হবে চীনকে। অপরদিকে অন্য উদীয়মান বাজারগুলোর ব্যাপ্তিও চীনের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার মতো যথেষ্ট বড় নয়। সরবরাহ চেইন ব্যাহত হওয়ায় অটোমোবাইল ও কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্টসহ ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন খাতের পশ্চিমা বড় কোম্পানিগুলোও এখন তাদের উত্পাদন বন্ধ করে দিয়েছে।

চীনকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ব্যবস্থা পুনর্গঠনে বাধ্য করার অজুহাতে মার্কিন প্রশাসন ট্যারিফ ব্যবস্থা নিয়ে যেভাবে চাপ প্রয়োগ করছে, তার যৌক্তিকতাকে নতুন করে খতিয়ে দেখতে বাধ্য করবে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। দুই দেশের মধ্যে জানুয়ারিতে সই হওয়া বাণিজ্য চুক্তি এখন অকার্যকরই বলা চলে। কারণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চলতি বছর চীনের পক্ষে বড় অংকের মার্কিন পণ্য ক্রয় করা সম্ভব হবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাণিজ্য সীমা আরোপ এবং ট্যারিফ ব্যবস্থাকে একযোগে কাজে লাগানোর কৌশল এখন উত্পাদনকারীদের প্রয়োজনীয়সংখ্যক যন্ত্রাংশের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার মতো নতুন অগ্রাধিকারগুলোর সঙ্গে পুরোপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সবচেয়ে ভালো ও সবচেয়ে মন্দ দিক হলো, বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন কানেকটিভিটির ওপর নির্ভরশীল। চীন ও পশ্চিমা বিশ্ব—উভয়েরই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববাণিজ্য এবং কার্যকর ও সচল সরবরাহ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার এখন অত্যন্ত জরুরি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here