অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলে থাকেন, দেশের উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজন থাকলেও বিনিয়োগ সেভাবে বাড়ছে না। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বেশ কয়েক বছর ধরেই স্থবির হয়ে আছে। কোনোভাবেই বিনিয়োগ বাড়ানো যাচ্ছে না।
বিনিয়োগ যেটুকু হচ্ছে তা সরকারি খাতে। আর সরকারি খাতের বিনিয়োগের অর্থই হচ্ছে অনুৎপাদন খাতে বিনিয়োগ, যেখানে দুর্নীতি ও অদক্ষতার বাহুল্য থাকে। সরকারি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় তার অধিকাংশই নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হয় না। ফলে অর্থ ও সময় উভয়ই অপচয় হয়। আর সরকারি কাজের তেমন একটা জবাবদিহিতা থাকে না। সরকারি খাতে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয় তার বেশির ভাগই উৎপাদনশীল নয় বরং ব্যক্তি খাতের জন্য উৎপাদন সহায়ক প্রকল্প মাত্র।
সরকারি উদ্যোগে যেসব রাস্তাঘাট এবং অন্য অবকাঠামো নির্মাণ হয় তা ব্যবহার করে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা নিজেদের উন্নতির পাশাপাশি জাতীয় অগ্রগতিতে অবদান রেখে থাকে। বহুল আলোচিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে। এই সেতু আমাদের জাতীয় জীবনে নানাভাবে অবদান রাখবে।
কিন্তু এই প্রকল্প কখনই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অবদান রাখতে পারবে না যদি ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা পদ্মা সেতুর সুবিধা ব্যবহার করে উৎপাদনশীল শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে না পারেন। পদ্মা সেতু প্রকল্প ঘিরে যদি ব্যক্তি খাতে উৎপাদনশীল কার্যক্রম ব্যাপক মাত্রায় শুরু হয়, তাহলেই কেবল এ প্রকল্পটি জাতির প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এটা স্বীকৃত যে সরকার ও রাষ্ট্র কখনোই ভালো ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হতে পারে না। সরকার ও রাষ্ট্র উৎপাদন বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করে দেবে আর তা ব্যবহার করে ব্যক্তি খাত জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখবে।
বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশের এ উন্নয়ন কৌশলকে ‘রোল মডেল’ হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ গত প্রায় ১১ বছর ধরে উচ্চমাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। চলতি অর্থবছরে এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে।
এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী তিনটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু এ প্রবৃদ্ধি কিভাবে অর্জিত হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। প্রবৃদ্ধি কি উৎপাদনশীল খাত থেকে আসছে নাকি অনুৎপাদনশীল খাত থেকে? অনুৎপাদনশীল খাতের প্রভাবে যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে সেই প্রবৃদ্ধি দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই আমাদের উৎপাদনশীল খাতের মাধ্যমে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রতি মনোযোগী হতে হবে।
আমাদের দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেসব সূচকের ওপর নির্ভর করে তার বেশিরভাগই এখন নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। পণ্য রফতানি আয় অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশেরও বেশি হ্রাস পেয়েছে। গত ৫ বছরের মধ্যে এমনটি আর কখনোই ঘটেনি। আমদানি ব্যয়ও আগের বছরের তুলনায় অনেকটাই কমে গেছে।
আমদানি ব্যয় হ্রাস পাওয়াটা আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও আমদানিনির্ভর দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হিসেবে বিবেচিত হতে পারত যদি সেই ক্রমহ্রাসমান ধারাটি বিলাসজাত ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে শুধু ঘটত। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে না। শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি ব্যয়ও অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি হ্রাস পাওয়ার অর্থই হচ্ছে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়।
অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে একমাত্র রেমিটেন্স প্রবাহে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। কিন্তু অর্থবছরের অবশিষ্ট সময়ে জনশক্তি রফতানি খাত থেকে আয়ের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে অনেক দেশই নতুন করে জনশক্তি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে।
এমনকি আগে থেকে যারা বিদেশে কর্মসংস্থান করছে, তাদেরও দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। আগামীতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে পারে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি উৎস হচ্ছে পণ্য রফতানি এবং জনশক্তি রফতানি খাত। এর মধ্যে পণ্য রফতানি খাত থেকেই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। অন্যদিকে তুলনামূলক বিচারে পণ্য রফতানি খাতের চেয়ে জনশক্তি রফতানি খাতটি বেশি সম্ভাবনাময়। কারণ এ খাতে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তার প্রায় পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে, যেহেতু জনশক্তি রফতানি খাতের জন্য কোনো কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি করতে হয় না।
এছাড়া খাতটি প্রবাসে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। অন্যদিকে পণ্য রফতানি খাতের আয় এখনও দৃশ্যত বেশি হলেও খাতটি যেহেতু আমদানিকৃত কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিনির্ভর তাই জাতীয় অর্থনীতিতে এর মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে অনেকটাই কম। পণ্য রফতানি করে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তার একটি বড় অংশই কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি করতে পুনরায় বিদেশে চলে যায়। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যেভাবে করোনা সংক্রমণ বিস্তার লাভ করছে তাতে আগামীতে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য নিশ্চিতভাবেই বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। পণ্য রফতানিকারকদের অনেকেই তাদের বিদেশি বায়ারদের কাছ থেকে সিগন্যাল না পাওয়ার কারণে পণ্য শিপমেন্ট করতে পারছেন না। জানা গেছে, বিদেশি বায়াররা এখন পণ্য আমদানিতে তেমন একটা আগ্রহ প্রকাশ করছেন না।
এছাড়া স্থানীয়ভাবে কাঁচামালের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের রফতানি এখন আর লাভজনক পর্যায়ে নেই। কিন্তু অর্ডার তো আগেই গ্রহণ করা হয়েছে। অনেকেই তাদের তৈরি পণ্য গুদামজাত করে রেখেছেন, কিন্তু রফতানি করতে পারছেন না বায়ারদের সিগন্যাল না পাওয়ার কারণে। এ অবস্থা আরও কিছুদিন চলতে থাকলে দেশের রফতানি বাণিজ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিটি দেশেরই অভ্যন্তরীণ ভোগ চাহিদা হ্রাস পেয়েছে।
ফলে বিশ্ববাজারে ক্রেতারা পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার বিবেচনা করছেন। বিশেষ করে করোনার সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য আগামীতে বিপাকে পড়তে পারে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভিয়েতনামকে জিএসপি সুবিধা প্রদান করায় দেশের রফতানিকারক, বিশেষ করে তৈরি পোশাক উৎপাদকরা মারাত্মক শঙ্কায় পড়েছেন। বাংলাদেশ এতদিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুল্কমুক্ত জিএসপি সুবিধা ভোগ করে আসছিল।
কিন্তু ভিয়েতনাম এ সুবিধা পাচ্ছিল না। সম্প্রতি স্বাক্ষরিত এক চুক্তির আওতায় ভিয়েতনাম এখন থেকে জিএসপি সুবিধা পাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৮টি দেশ থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক সামগ্রীর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সামগ্রীর ৬০ শতাংশই রফতানি করা হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে।
ভিয়েতনাম আগামী ১০ বছরের মধ্যে তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অতিক্রম করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এখন মনে হচ্ছে, ১০ বছর প্রয়োজন হবে না, আগামী দু-তিন বছরের মধ্যেই ভিয়েতনাম তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে অতিক্রম করে যাবে।
অনেক দিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা নতুন রফতানি অঞ্চল খুঁজে বের করার তাগিদ দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের সেই পরামর্শ কর্তৃপক্ষীয় পর্যায়ে কোনো মূল্যায়ন হয়নি। এছাড়া স্থানীয় কাঁচামালনির্ভর পণ্য উৎপাদনের প্রতি জোর দেয়ার কথা বলা হলেও তা করা হয়নি। ফলে আগামীতে রফতানি বিপর্যয় হতে পারে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশকে টেকসই প্রোডাক্টিভ সেক্টর বিকাশের কথা ভাবতে হবে। এজন্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ানোর জন্য সার্বিক ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলে থাকেন, দেশের ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। একই স্থানে স্থবির হয়ে আছে। কয়েক বছর ধরেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের হার জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশে স্থবির হয়ে আছে। কিন্তু এই মন্তব্য সঠিক নয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার প্রতি বছরই বাড়ছে। কাজেই বিনিয়োগ ২২-২৩ শতাংশে সীমিত থাকলেও সেটা যে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। অর্থনীতির আকার যদি বৃদ্ধি না পেত, তাহলে বলা যেত বিনিয়োগের পরিমাণ ও হার বাড়ছে না। তবে এটা ঠিক, আমরা যেভাবে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রত্যাশা করি সেভাবে বাড়ছে না।
যেমন- সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। এটা আমরা অর্জন করতে পারিনি।
বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করে চলেছে তাকে টেকসই ও কার্যকর করতে হলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের হার জিডিপির ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশে উন্নীত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এটা করতে হলে শুধু বড় আকারের শিল্প স্থাপন করে তা সম্ভব হবে না।
এজন্য এসএমই খাতের বিকাশ ঘটাতে হবে। বর্তমানে জিডিপিতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এসএমই খাতের অবদান ২৫ শতাংশ। একে অন্তত ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এসএমই খাতের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এতে পুঁজির প্রয়োজন হয় তুলনামূলকভাবে কম। ফলে সামান্য পুঁজি নিয়েই একজন সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তা এসএমই শিল্প স্থাপন করতে পারেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারিকৃত এক সার্কুলারের মাধ্যমে কটেজ ও মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিকে এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত করে এ খাতের নতুন নামকরণ করা হয়েছে কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (সিএমএসএমই) খাত। এর ফলে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তারা এসএমই খাতের জন্য দেয়া প্রণোদনামূলক সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় এসএমই উদ্যোক্তাদের বিনা জামানতে ঋণ দানের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। এর ফলে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তা, বিশেষ করে মহিলা উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে জটিলতা এড়াতে পারবেন। চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রথমবারের মতো ‘স্টার্ট আপ বিজনেস’ নামে একটি খাত তৈরি করে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
সম্ভাবনাময় নতুন উদ্যোক্তারা এ ফান্ড থেকে অর্থায়ন পেতে পারবেন। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) উদ্যোগে সারা দেশে ২৪ হাজার সম্ভাবনাময় নতুন উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এসব উদ্যোগকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে আমাদের উৎপাদনশীল খাতের বিকাশ ঘটাতে হবে। আগামীর কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে টেকসই উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।