দেশের
বেসরকারি খাতে নেতৃত্ব দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বছরে ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি
আয় করছে ১০টির বেশি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবই পারিবারিক ব্যবসা। এর
মধ্যে সবচেয়ে বেশি বার্ষিক আয় এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের (একেকে)। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের
অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
“বাংলাদেশ’স জার্নি টু মিডল-ইনকাম স্ট্যাটাস: দ্য রোল অব দ্য প্রাইভেট সেক্টর” শীর্ষক এ প্রতিবেদন গতকাল প্রকাশ করেছে আইএফসি। এতে বলা হয়, ব্যক্তি খাতে নেতৃত্বদাতা যেসব প্রতিষ্ঠানের আয় শতকোটি ডলারের বেশি সেগুলোর মধ্যে রয়েছে একেকে, বসুন্ধরা, মেঘনা, যমুনা, স্কয়ার গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, বেক্সিমকো, ইউনাইটেড গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, পিএইচপি গ্রুপ, প্রাণ ও পারটেক্স। আগে ব্যবসা শুরু করতে পারার সুবিধা (ফার্স্ট মুভার অ্যাডভানটেজ) নিয়ে পর্যায়ক্রমে বড় হয়েছে এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আর এ সমৃদ্ধিকে সম্ভবপর করেছে সৃজনশীল অর্থায়ন পদ্ধতির ব্যবহার এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে শক্তিশালী সংযোগ ব্যবস্থার সহায়তা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের বার্ষিক আয় ১৭০ কোটি ডলার। ১৯৪৫ সালে যাত্রা করা প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ তালিকাও বৈচিত্র্যপূর্ণ। টেলিকম, বস্ত্র, অতিথি সেবাসহ লজিস্টিক, ফিশিং ও আবাসন খাতেও ব্যবসা রয়েছে করপোরেট গ্রুপটির।
এ কে খান অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক আবুল কাসেম খান বণিক বার্তাকে বলেন, শুরুর দিককার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা ও এগিয়ে নেয়ার কাজটি করেছিলেন মূলত আমার দাদা ও বাবা। তাদের চ্যালেঞ্জের মূলে ছিল মূলধন। তত্কালীন অর্থায়ন ব্যবস্থায় বৈষম্যের কারণেই মূলধন সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে। তখন হাতেগোনা কিছু ব্যবসায়ী ছাড়া অন্যদের অর্থায়ন সম্ভব হতো না বৈষম্যের কারণে। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও অর্থায়নে সমস্যা আছে।
শুরুর দিকে প্রযুক্তিগত দক্ষতার উন্নয়ন করতে বিদেশীদের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারেও ব্যবসা করতে হয়েছিল উল্লেখ করে আবুল কাসেম খান বলেন, তখনকার দিনের তুলনায় সমস্যা এখন কম। তখন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নীতিনির্ধারকদের দূরত্ব ছিল বেশি। এখন আমরা সমস্যা হলে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পাচ্ছি। ফলে সহযোগিতামূলক আচরণের মাধ্যমে সমস্যা মোকাবেলা করে এগোনো যাচ্ছে।
১৫০ কোটি ডলারের বার্ষিক আয় নিয়ে আইএফসির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বসুন্ধরা। ১৯৮৭ সালে যাত্রা করা সিমেন্ট, আবাসন, কাগজ ও ইস্পাত খাতের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের অন্যতম পুরনো ও সফল আবাসন প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যা দিয়েছে আইএফসি। প্রতিবেদনে বসুন্ধরার বৈচিত্র্যময় বিনিয়োগের প্রশংসা করেছে তারা।
তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা মেঘনা গ্রুপের ব্যবসার খাতগুলোর মধ্যে আছে ভোজ্য তেল, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, চিনি, রাসায়নিক, সিমেন্ট, কাগজ ও প্রিন্টিং। কয়েকটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে মেঘনার বার্ষিক আয় ১৫০ কোটি ডলার। গ্রুপটিকে দেশের নেতৃস্থানীয় বৃহৎ করপোরেশন উল্লেখ করে আইএফসি জানিয়েছে, এর কর্মী সংখ্যা ৩০ হাজারেরও বেশি।
১৯৭৬ সালে কামাল ট্রেডিং নামে জন্ম নেয় বর্তমান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। উৎপাদন খাতে গ্রুপটির যাত্রা ভোজ্য তেল পরিশোধন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ১৯৮৯ সালে যাত্রা করা ওই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল মেঘনা ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
আইএফসির তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে আছে আবাসন, হোয়াইট গুডস ও মিডিয়া খাতে ব্যবসাকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা গ্রুপ। যমুনার বার্ষিক আয় ১৩০ কোটি ডলার। ১৯৭৪ সালে যমুনা ইলেকট্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং কো. লিমিটেড যাত্রা করে। এর পরের বছর ১৯৭৫ সালে ইলেকট্রিক্যাল অ্যাকসেসরিজ প্রস্তুতকারক হিসেবে এ খাতের পথিকৃতের দাবিদার যমুনা পর্যায়ক্রমে বর্তমান অবস্থানে এসেছে। বর্তমানে যমুনা গ্রুপের আওতায় আছে ২৪টি প্রতিষ্ঠান।
স্বাস্থ্যসেবা, ভোক্তা ব্র্যান্ড, টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক খাতের বড় প্রতিষ্ঠান স্কয়ার। ১৯৫৮ সালে ছোট ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি হিসেবে যাত্রা করা প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় এখন ১২০ কোটি ডলার।
তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে টিকে গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় ১০০ কোটি ডলার। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে নিত্যপণ্যের বাণিজ্য, নির্মাণসামগ্রী, ভোজ্য তেল, কাগজ ও টেক্সটাইল। ১৯৭২ সালে যাত্রা করা টিকে গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আছে ২৬টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হচ্ছে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের।
আয়ের দিক থেকে আকিজ গ্রুপ রয়েছে সপ্তম অবস্থানে। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় ১০০ কোটি ডলার। গ্রুপটির ব্যবসার খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্মাণসামগ্রী, দুগ্ধপণ্য, পানীয়, কাগজ, এলপিজি ইত্যাদি। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে পাট বাণিজ্যের মাধ্যমে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি এখন নির্মাণ ও তামাক খাতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলে উল্লেখ করেছে আইএফসি।
বেক্সিমকো রয়েছে তালিকার অষ্টম অবস্থানে। ১০০ কোটি ডলার বার্ষিক আয়ের এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে ওষুধ, তৈরি পোশাক, বস্ত্র, আবাসন ও সিরামিক। সত্তর দশকের শুরুর দিকে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কনগ্লোমারেট উল্লেখ করে আইএফসি বলছে, দেশের পুঁজিবাজারে বেক্সিমকোর মূলধন সবচেয়ে বেশি।
নবম অবস্থানে থাকা ইউনাইটেড গ্রুপের বার্ষিক আয় ১০০ কোটি ডলার। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার খাতগুলো হলো বিদ্যুৎ, আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, উৎপাদন, পোর্ট-টার্মিনাল অ্যান্ড শিপিং এবং খুচরা ও সেবা খাত। গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭৮ সাল।
আইএফসির তালিকায় দশম অবস্থানে রয়েছে সিটি গ্রুপ। ১৯৭২ সালে সিটি অয়েল মিল স্থাপনের মাধ্যমে যাত্রা করা সিটি গ্রুপের বার্ষিক আয় ১০০ কোটি ডলার। প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা করছে ব্র্যান্ডেড স্টেপল, নিত্যপণ্য ও অর্থনৈতিক অঞ্চল খাতে।
আইএফসির প্রতিবেদনে উঠে আসা নেতৃস্থানীয় ২৩ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাদশ থেকে ২৩তম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে পিএইচপি, প্রাণ, পারটেক্স গ্রুপ, নোমান গ্রুপ, বিএসআরএম, কেডিএস গ্রুপ, হা-মীম, এসিআই লিমিটেড, ট্রান্সকম, ভিয়েলাটেক্স, প্যাসিফিক জিন্স, কনফিডেন্স গ্রুপ ও ওয়ালটন। এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয় ৫০ থেকে ১০০ কোটি ডলারের মধ্যে।
আইএফসি বলছে, দেশের অর্থনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছে ব্যক্তি খাত। প্রবৃদ্ধি, আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান, মজুরি বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসন সবই হচ্ছে ব্যক্তি খাতের হাত ধরে। দেশে জ্বালানি খাতে ব্যক্তি খাতের অংশ ৪০ শতাংশ। এভিয়েশনের ক্ষেত্রে এ হার ৭৫ শতাংশ। মোট শ্রমশক্তির ৯৫ শতাংশ বা ৫ কোটি ৭০ লাখ কর্মসংস্থান হয় ব্যক্তি খাতে। এছাড়া দেশের মোট রাজস্বের ৮ শতাংশেরই জোগান দিচ্ছে শীর্ষ ১০ করদাতা প্রতিষ্ঠান।
আইএফসির প্রাইভেট সেক্টর স্পেশালিস্ট ড. এম. মাসরুর রিয়াজ বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগ ট্রেডার হিসেবে শুরু করেছিল। সেই ট্রেডিং থেকে ক্যাপিটাল ফরমুলেশন হয়েছে, ট্রেডিং করতে গিয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে পরিচিতি তৈরি হয়েছে। ফলে পরবর্তী সময়ে বেসরকারি খাতে উৎপাদনমুখী শিল্প স্থাপনে তাদের ট্রেডিং ও বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক কাজে লেগেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জন ভালো এমন তথ্য উল্লেখ করে আইএফসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এর পরও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিনিয়ত নানা চ্যালেঞ্জ, প্রতিকূলতা ও বাধা মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধান বাধা হলো অ্যাকসেস টু ফিন্যান্স বা অর্থায়ন প্রাপ্যতা।
এ বিষয়ে মাসরুর রিয়াজ বলেন, উৎপাদনমুখী খাতে বড়দের বিনিয়োগের পরই ব্যাংকিং খাত উন্মুক্ত হতে থাকে । তখন অর্থায়ন সহজ না হলেও বড়দের ব্যবসার অভিজ্ঞতার চাপেই ব্যাংক খাত উন্মুক্ত হতে শুরু করে। আমাদের জরিপ বলছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অ্যাকসেস টু ফিন্যান্স বা অর্থায়ন সমস্যাটাই ব্যবসার প্রধান। আর এখন বড় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমে আসছে। এর কারণ খুঁজে বের করতে আরো অনুসন্ধান প্রয়োজন।
এছাড়া ব্যক্তি খাতকে আর যেসব সমস্যা মোকাবেলা করতে হয় বলে জানিয়েছে আইএফসি, এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক প্রতিযোগী, করহার, শুল্ক ও বাণিজ্য নীতি, কর্মীর শিক্ষার মানে দুর্বলতা, বিদ্যুৎ, লাইসেন্সিং ও অনুমোদন, ভূমি প্রাপ্যতা, পরিবহন, অপরাধ-চৌর্যবৃত্তি, কর প্রশাসন, শ্রম বিধি ও অন্যান্য।