করোনায় অর্থনীতির ১৪ খাত ক্ষতিগ্রস্ত

0
296

করোনা প্রাদুর্ভাবের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। এরই মধ্যে দেশের অন্তত ১৪টি খাতে সমস্যা তৈরি হয়েছে। ট্যারিফ কমিশনের প্রাথমিক হিসাব বলছে, আমদানি-রফতানি সংকুচিত হওয়ায় কয়েকটি খাতে অন্তত ৬০০০ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে কাঁচামালের অভাবে দেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানার উৎপাদন সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একইভাবে কমে আসছে আমদানিনির্ভর পণ্যের সরবরাহ। বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠন বলছে, ভবিষ্যতে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া কিছু পণ্যের সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের শিল্প ও বাণিজ্যের ১৪টি খাত করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্যে প্রতিবেদনে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পোশাক খাতের অ্যাক্সেসরিজ, প্রসাধন, বৈদ্যুতিক পণ্য, পাট সুতা, মুদ্রণ শিল্প, চিকিৎসা সরঞ্জাম, চশমা, কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিক পণ্য, কাঁকড়া ও কুঁচে এবং প্লাস্টিক শিল্পসহ মোট ১৩ খাতের ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যারা ভ্যালু চেইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা গত দুই মাস ধরেই ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। সেটা আগামী দুই মাসের মধ্যে বোঝা যাবে।’

তিনি বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠানের টেকনেশিয়ানরা চীনের নাগরিক। এখন চীন থেকে টেকনেশিয়ানরা আসতে পারছেন না। ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠান এখন চলছে না। একইভাবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ সরকারের বড় প্রকল্পগুলোও সময়মতো শেষ করতে পারবে না।’

ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই’এর সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বলেন, ‘করোনার কারণে আমাদের দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে কী প্রভাব পড়ছে, তা জানার জন্য আমরা বিভিন্ন চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের মতামত নিচ্ছি। পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে ওভেন ও সুয়েটার খাতে এর প্রভাবটা বেশি হবে। আমরা চীনের বিকল্প বাজারও খুঁজছি।’

জানা গেছে, দেশের শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য থেকে শুরু করে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ এবং নিত্য ব্যবহার্য নানা পণ্যের বড় উৎস চীন। ওষুধের কাঁচামালের একটি বড় অংশ চীন থেকে আসে। গত এক সপ্তাহে এলসি খোলার হার প্রায় ৩৭ শতাংশ কমেছে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারেও অনেক পণ্যের দাম বাড়ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত কাঁচামালের দামও বাড়ছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে ক্ষতির মুখে পড়বে কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ খাতও। কারণ, চীন থেকে আগে প্রতি মাসে এই খাতে আনুমানিক ৯০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হতো। 

ট্যারিফ কমিশন বলছে, ওভেন পোশাকের ৬০ শতাংশ বস্ত্র আসে চীন থেকে। আর নিট পোশাকের ১৫-২০ শতাংশ কাঁচামাল এবং ডাইংয়ের রাসায়নিকের বড় উৎস চীন। এছাড়া বাংলাদেশের চামড়া, পাট, কাঁকড়াসহ কিছু পণ্যের বড় রফতানি বাজার চীন। চামড়া খাতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি টাকা। ইলেকট্রনিক পণ্যের ৮০ শতাংশ আসে চীন থেকে।

করোনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, বস্ত্র ও বস্ত্রজাতীয় পণ্য, গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজসহ বিভিন্ন উপকরণে চীনের ওপর নির্ভরতা প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া অন্তত ৪০ শতাংশ যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশও আনতে হয় চীন থেকে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত এক মাসে চীন থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি কমেছে তা স্বাভাবিক হতে আগামী ৬ মাস সময় লাগবে।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘এক কথায় আমরা আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছি। এরই মধ্যে সব ধরনের আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ও পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এমনকি ডাইংয়ের খরচও বাড়ছে অযাচিতভাবে।’

তিনি বলেন,  বিজিএমইএর পক্ষ থেকে একটি সেল খোলা হয়েছে। সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার ক্ষতির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে যদি চীন থেকে পণ্য আসা শুরু না হয়, তাহলে আমাদের বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে স্বাভাবিক আমদানি-রফতানি বন্ধ রয়েছে। এজন্য ব্যাংকগুলো সময়মতো ঋণের কিস্তির টাকা পাবে কিনা তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি ব্যাংকগুলো সদয় থাকবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি’র চেয়ারম্যান এবং ইস্টার্ন  ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার।

তিনি বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি চলছে তাতে মনে হচ্ছে, করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা হয়তো আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যে পড়বেন। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা ক্ষতির মুখে পড়বেন ব্যাংকগুলো তাদের পাশে দাঁড়াবে।’

চীনের সঙ্গে সরাসরি ব্যবসা করা কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, আমদানি-রফতানিসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে এখন। নতুন কোনও এলসিও (ঋণপত্র) খোলা যাচ্ছে না। ফলে কাঁচামালের অভাবে শিগগিরই অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

এ প্রসঙ্গে চায়না বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাবের সভাপতি আবদুল মোমেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এরই মধ্যে বড় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়তে শুরু করেছেন। এখন নতুন কোনও অর্ডারও পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করেও চীনের কোনও ব্যাংকের সঙ্গে এলসি খুলতে পারছি না। রফতানিও বন্ধ হয়ে গেছে।’

চলমান পরিস্থিতিকে ভয়াবহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যে চীনের বিকল্প খুঁজবে, স্বল্প মেয়াদে সে সুযোগটিও কম। আবার বিকল্প কোনও দেশও  আমরা পাচ্ছি না। অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসছে বলা চলে।’ 

বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আল মামুন জানিয়েছেন, আগামী দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে পণ্যের শিপমেন্ট শুরু হতে পারে। চীনে এত দিন ছুটির কারণে শিপমেন্ট বন্ধ ছিল। এখন আবার উৎপাদন শুরু হয়েছে দেশটিতে। 

প্রসঙ্গত, গত বছরের শেষের দিকে চীনে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তারপর থেকেই চীনের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার কারণে অন্য যে কোনও দেশের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের আঘাত পাবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি আবদুল কাদের খান বলেন, ‘বাজারে শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, খুচরা যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। কারণ, পুরো চেইন ভেঙে পড়ার উপক্রম।’

তিনি বলেন, ওভেন পোশাকের ২০-৩০ শতাংশ দেশীয় বাজারে উৎপাদন হয়, বাকি ৭০-৮০ শতাংশই চীন থেকে আসে। এ বিশাল পরিমাণ কাঁচামাল আপাতত বাংলাদেশে উৎপাদন করা সম্ভব নয়।

করোনার কারণে কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি বন্ধ রয়েছে চীনে। মূলত, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ কুঁচে ও কাঁকড়া চীনে রফতানি হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ইতোমধ্যে এ খাতে ১০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে রফতানি শুরু না হলে ক্ষতি ৩৫০-৪০০ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘করোনার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে খানিকটা পড়তে শুরু করেছে। তবে আগামী দুই সপ্তাহ পরে সত্যিকার অর্থে কী প্রভাব পড়তে পারে, তা বোঝা যাবে। কারণ, চীনের অফিস-কারখানা সবেমাত্র খুলতে শুরু করেছে। এছাড়া ওদের বন্দরের কার্যক্রম এখনও ঠিকমতো শুরু হয়নি।’

জানা গেছে, বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশেরও বেশি আসে চীন থেকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্য ছিল প্রায় ১৪.৬৯ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশের রফতানি ছিল ৮৩ কোটি ডলার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here