চীন থেকে শিল্পের কাঁচামাল ও বাণিজ্যিক পণ্য আমদানিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশে। ইতিমধ্যে চীনের বন্দরগুলো থেকে বাংলাদেশমুখী জাহাজে পণ্য পরিবহন কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো জাহাজে চীনের পণ্য পরিবহন ৫০ শতাংশে নেমেছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে নববর্ষের ছুটির আগে চীনের বন্দর থেকে জাহাজে তোলা পণ্যও হাতে পেতে দেরি হচ্ছে। চীন থেকে অন্য বন্দর হয়ে চট্টগ্রামে আসার পথে সতর্কতামূলক ব্যবস্থার মধ্যে পড়ায় জাহাজ চলাচলের সময়সূচিও ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ছুটি শুরুর আগে যেসব কাঁচামাল বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য চীনের বন্দরে পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোই মূলত এখন তাঁরা হাতে পেতে শুরু করেছেন। তাতে আগামী মাসের পণ্য রপ্তানিতে হয়তো খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তবে এপ্রিল ও মে মাসের পণ্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, ওই সময়ে রপ্তানির কাঁচামাল এখনো জাহাজে বোঝাই শুরু হয়নি। এসব পণ্য হাতে পেতে অন্তত দুই সপ্তাহ পিছিয়ে পড়েছেন উদ্যোক্তারা।
চীনে কয়েকটি প্রদেশে গত সোমবার ছুটি শেষ হলেও এখনো বেশির ভাগ কারখানা সচল হয়নি। আবার অনেক কারখানা খুলবে ১৮ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির পর। কারখানা সচল হওয়ার পর পোশাকের কাঁচামাল উৎপাদন করে জাহাজীকরণে সময় লাগবে। সরবরাহব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় আগামী কয়েক মাস ভুগবেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।
নারায়ণগঞ্জের এমভি নিট ফ্যাশনের ১২ লাখ ডলারের মেয়েদের পোশাকের একটি চালান যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করার কথা এ মাসের শেষে। এই পণ্য প্রস্তুত করতে অ্যাকসেসরিজ বা আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম চীনের সাংহাই বন্দর থেকে জাহাজীকরণের কথা ছিল ২-৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এখনো তা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল মঙ্গলবার চীনের সাংহাই শহরে সরবরাহকারীর সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের কার্যালয় ২০ ফেব্রুয়ারি খুলবে। ২৫ ফেব্রুয়ারি জাহাজে বোঝাই করার সময়সূচি নির্ধারণ করেছে। তাতে এ মাসে পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা নেই।
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের শতভাগ রপ্তানিমুখী তাঁবু কারখানা এইচকেডি ইন্টারন্যাশনালের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শহীদুল্ল্যা প্রথম আলোকে জানান, তাঁবু কারখানাটির কাঁচামালের একটি চালান ৭ ফেব্রুয়ারি চীনের বন্দর থেকে জাহাজে বোঝাই করার কথা। সেই সময়সূচি দুই দফা পিছিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত হয়েছে। এটি ঠিক থাকে কি না, তা-ও নিশ্চিত নয়।
কাঁচামাল আমদানি কমছে
চীন থেকে
সমুদ্রপথে আমদানি কাঁচামাল ও বাণিজ্যিক পণ্যের প্রায় পুরোটাই আনা হয়
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। চারটি আন্তর্জাতিক শিপিং লাইন ১৯টি জাহাজে পণ্য
পরিবহন করে। প্রতি মাসে একবার এই ১৯ জাহাজ চট্টগ্রামে পণ্য নিয়ে আসে। এর
বাইরে সিঙ্গাপুর হয়ে কনটেইনার কোম্পানিগুলোও বিভিন্ন জাহাজে পণ্য আনা-নেওয়া
করে।
কসকো শিপিং লাইন চীনের ইয়াংপো বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে চট্টগ্রামে তিনটি জাহাজে পণ্য পরিবহন করে। কোম্পানির এমভি নভোসেবা জাহাজটি প্রতি যাত্রায় চীনের বন্দর থেকে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ কনটেইনার পণ্য নিয়ে আসে। ৬ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি চীনের ইয়াংপো বন্দর থেকে মাত্র ১৪১ কনটেইনার বোঝাই করে সিঙ্গাপুর হয়ে চট্টগ্রামের অভিমুখে রয়েছে।
চীনের বন্দর থেকে কাঁচামাল পরিবহন কমে গেছে, ব্যাহত জাহাজ চলাচলের সূচি। বিপাকে পড়েছে উদ্যোক্তারা।
দক্ষিণ কোরিয়ার দুটি আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনের (হুন্দাই ও সিনোকর) কোরিয়া-চীন-বাংলাদেশ বা কেসিবি সার্ভিসে পাঁচটি জাহাজও চীন থেকে পণ্য পরিবহন করে। এসব জাহাজের একটি এসটি জন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ১০০ কনটেইনার কম পেয়েছে।
চট্টগ্রামের কন্টিনেন্টাল ট্রেডার্সের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ওশান ইন্টারন্যাশনাল কোরিয়ার হুন্দাই মার্চেন্ট মেরিনের স্থানীয় প্রতিনিধি। একইভাবে চীনের কসকো কোম্পানির স্থানীয় এজেন্টও কন্টিনেন্টাল ট্রেডার্স। কন্টিনেন্টাল ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান ইকবাল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে এ মাসের শেষে চীন থেকে পণ্য পরিবহন আরও কমবে।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানি মায়ের্সক লাইনের ১১টি জাহাজ চীনের সাংহাই, নিংবো, তাইচ্যাং ও ডালিয়া বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন করে। কোম্পানির কর্মকর্তারাও জানালেন, এখন চীনের বন্দরে বোঝাই হওয়া প্রতিটি জাহাজে প্রত্যাশা অনুযায়ী কনটেইনার পাওয়া যাচ্ছে না। আমদানির হার কমতির দিকে।
জাহাজের সময়সূচি পিছিয়েছে
করোনাভাইরাসের
প্রভাবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলো চীন থেকে আসা জাহাজ
আলাদা করে পরীক্ষা (কোয়ারেন্টাইন) করছে। তাতে ১৪ দিন পার না হওয়ার আগে এসব
জাহাজ সেখানকার বন্দর জেটিতে ভিড়ে পণ্য খালাস করতে পারছে না। এসব বন্দর
হয়েও অনেক পণ্য চট্টগ্রামে আনা হয়। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সতর্কতামূলক
ব্যবস্থা নেওয়ায় জাহাজ চলাচলে সময় বেশি লাগছে।
রপ্তানিমুখী জুতার সোল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আর জে এম ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসীম আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, চীনের শিয়ামেন বন্দর থেকে মালয়েশিয়া হয়ে ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে তাঁর কারখানার জুতার সোলের কাঁচামালের একটি চালান পৌঁছানোর কথা। কিন্তু ১৪ দিন পার না হওয়া পর্যন্ত মালয়েশিয়ার বন্দরে না নামানোর কারণে চালানটি দুই সপ্তাহ পরে হাতে পাবেন তিনি। তাতে কারখানার একটি লাইনের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
প্রভাব পড়বে শিল্পে
করোনাভাইরাসের
প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ার আশঙ্কা রপ্তানিমুখী পোশাক খাতে। গত ২০১৮-১৯
অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ২১৭
কোটি মার্কিন ডলারের কাঁচামালের বড় অংশই এসেছে চীন থেকে। আবার পোশাক
কারখানার যন্ত্রপাতির যন্ত্রাংশের সিংহভাগই আসে চীন থেকে। পোশাকশিল্প ছাড়াও
চামড়া ও ওষুধের কাঁচামালও আসে চীন থেকে। এ ছাড়া রড, ঢেউটিন, সিরামিকস
তৈরির কাঁচামালেও চীনের ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে।
পাটখড়ির ছাই বা চারকোল রপ্তানির একমাত্র বাজার চীন। এক দশক ধরে গড়ে ওঠা এই খাতে যুক্ত হয়েছেন ২২ জন উদ্যোক্তা। তাঁদের সবার কারখানায় এখন পাটখড়ির ছাইয়ের স্তূপ জমেছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রিগালো প্রাইভেট লিমিটেডের কারখানায় এক হাজার টন পাটখড়ির ছাই স্তূপ হয়ে আছে। রপ্তানি আদেশ না পাওয়ায় এসব পণ্য চীনে পাঠানো যাচ্ছে না বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আবু মোহাম্মদ মান্না ওয়াদুদ।
বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচারিং এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মির্জা শিপন জানান, অনেকেই উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। ভরা মৌসুমে রপ্তানি না হওয়ায় এ খাতের উদ্যোক্তারা বিপদে পড়েছেন।
সামগ্রিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, চীনের করোনাভাইরাসের স্বল্পকালীন প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। আবার যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল নির্ধারিত সময়ে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। রোগটি দ্রুত প্রশমন করা না গেলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের এক-চতুর্থাংশ চীন থেকে আসে। এ ধরনের অতিনির্ভরশীলতা ভালো নয়। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা। বেশি আমদানি হয়, এমন পণ্যের বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আমদানির সময় ও দামের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, কম সময়ে পণ্য প্রাপ্তি ও প্রতিযোগিতামূলক দামের কারণেই চীন থেকে আমাদের আমদানি বেড়েছে।’ সিপিডির এই গবেষক বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধ, করোনাভাইরাসসহ নানা কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চীনের বিকল্প দেশ খুঁজছেন। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করে সুযোগটি নেওয়া। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া কিন্তু বিনিয়োগকারীদের নিজেদের দেশে টানছে।