বড় হচ্ছে দেশের সফটওয়্যার খাত

0
293

বড় হচ্ছে দেশের সফটওয়্যার খাত। দেশে সফটওয়্যারের আমদানি বাড়লেও সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দেশী সফটওয়্যার ব্যবহারের প্রবণতাও বাড়ছে। বিশেষ করে এ খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে ব্যাংকিং খাতে। এর আগে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে একচেটিয়া বিদেশী সফটওয়্যার ব্যবহার হয়ে এলেও বর্তমানে ৩১টি ব্যাংক আট ধরনের দেশি সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। অর্থাৎ ৫৯টি ব্যাংকের অর্ধেকেরও বেশি ব্যাংক এখন চলছে দেশীয় সফটওয়্যারে।

ব্যাংকিং খাতে দেশী সফটওয়্যারের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি পুরো ব্যাংকিং খাতই দেশীয় সফটওয়্যারে পরিচালনা হওয়া উচিত বলে মত তাদের। তবে কিছু কিছু ব্যাংক বলছে, দেশীয় সফটওয়্যার এখনও তাদের পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তবে দেশের সফটওয়্যার খাতের অগ্রগতির চিত্রে তারাও আশাবাদী, একসময় দেশীয় সফটওয়্যারেই পরিচালিত হবে ব্যাংকিং খাত।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, ব্যাংকিং খাতে দেশীয় সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়ার তথ্য অত্যন্ত ইতিবাচক। ব্যাংকগুলোতে দেশীয় সফটওয়্যারের ব্যবহার অন্যদেরও দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করতে আত্মবিশ্বাস জোগাবে।

বেসিস সভাপতি আরও বলেন, এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আর্থিকখাতে বিদেশী সফটওয়্যার ব্যবহারের ক্ষেত্রে তথ্য পাচারের ঝুঁকি থেকে যায়। তারা কখনও ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে দিচ্ছে কি না, কিংবা তথ্য চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে না, সে নিশ্চয়তা নেই।

এ প্রসঙ্গে সংগঠনটির সিনিয়র সহ-সভাপতি ফারহানা এ রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতে দেশীয় সফটওয়্যারের ব্যবহার বৃদ্ধি শিল্পটির জন্য বড় একটি সুখবর। এটি খুবই ইতিবাচক একটি দিক। আর দেশে ব্যাংক খাত সফটওয়্যারের বড় একটি বাজার। ব্যাংকের মতো আর্থিক খাতে দেশীয় সফটওয়্যারে ব্যবহার বাড়লে অভ্যন্তরীণ বাজারের অন্য ক্রেতাদের কাছেও আস্থা বাড়বে। এখন যেসব ব্যাংক বিদেশী সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, খরচ বাঁচাতে এক সময় তারাও দেশী সফটওয়্যার ব্যবহার করবে বলে আমরা আশাবাদী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ৫৯টি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ৩১টি ব্যাংক কোর ব্যাংকিংসহ আট ধরনের দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। তবে দেশীয় কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহারকারী ব্যাংকের সংখ্যা জানাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যাংকিং খাতে ধীরে ধীরে দেশীয় সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়ছে। এর আগে আরও কমসংখ্যক ব্যাংকে দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার হতো। দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগেই দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে।

বেসিস নেতাদের মতে, প্রায় সব ব্যাংকই ছোট ছোট দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। দেশীয় কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহারকারী ব্যাংকের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বেসিসের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশেই সফটওয়্যারের চাহিদা প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের। সফটওয়্যার খাত থেকে রফতানি আয়ও প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের। তবে রফতানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমদানিও। গত চার বছরে সফটওয়্যার আমদানি বেড়েছে ছয় গুণ। সবমিলিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংকসহ সরকারী কেনাকাটায় দেশীয় সফটওয়্যারের ব্যবহারকে আরও বেশি প্রাধান্য দেয়ার দাবি করে আসছেন বেসিসের নেতারা।

সফটওয়্যার প্রস্তুতকারী ইরা ইনফোটেক লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেশীয় সফটওয়্যার দিয়েই এখন পুরো ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। ব্যাংক এশিয়ার পুরো কার্যক্রম আমাদের তৈরি সফটওয়্যার দিয়ে চলছে। অর্থাৎ ব্যাংক এশিয়াতে যত সফটওয়্যার, তা আমাদের তৈরি। প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকিং কার্যক্রমে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া ব্যাংকের গ্রাহকদের আইটি এনাবলড সার্ভিস দেয়ার ক্ষেত্রে তারা শীর্ষে রয়েছে।

সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, দেশীয় সফটওয়্যার খাতের অনেক সম্ভবনা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এখন সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে খাতটিতে এখনও সেভাবে উদ্যোক্তা গড়ে উঠেনি।

ইরা ইনফোটেকের সিইও জানান, ব্যাংক এশিয়া, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক তাদের তৈরি দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে আইএসটেলার, এজেন্ট ব্যাংকিং, আরটিজিএসের মতো দেশী সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে।

আরেক সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রিসোর্সেস লিমিটেডের ডিজিএম (ইম্পিমেন্টেশন) খাজা মাহমুদ হোসেন জাকির বলেন, বেশিরভাগ ব্যাংকই কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করছে। আর যে ব্যাংকগুলো দেশী সফটওয়্যার ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলো মূলত ছোট-খাটো।

পদ্মা ব্যাংকের ডিএমডি ও হেড অব আইটি সাহাদাত হোসেন বলেন, আমরা মূলত আইটি সার্ভিস নিয়ে থাকি ভেন্ডরদের কাছ থেকে। এছাড়া আমাদের নিজস্ব কর্মী দিয়েই কিছু কিছু সফটওয়্যার তৈরি করেছি। ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে জন্য আমাদের নিজস্ব সফটওয়্যার রয়েছে। পদ্মা ক্লিক নামেও আমাদের একটি সফটওয়্যার রয়েছে। কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বের খ্যাতনামা সফটওয়্যার ডেমেনস্টি টি২৪ সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকি। দেশের অনেক ব্যাংকও এই সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে থাকে।

এ প্রসঙ্গে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকিং লিমিটেডের (ইউসিবিএল) এ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাহমুদুর রশীদ বলেন, ব্যাংকে এখন দেশী সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়ছে। তবে কম ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে কোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে দেশীয় সফটওয়্যারগুলো সেভাবে তৈরি করা হয়নি। তৈরি করার মতো অবস্থায় হয়ত সবাই এখনও যায়নি। এছাড়া যখন ওই সফটওয়্যার আমরা ইনস্টল করছি, তখন আর সার্ভিস পাওয়া যাচ্ছে না। সার্ভিস কন্টিনিউয়েশন না থাকায় হয়ত আস্থার কিছুটা সঙ্কট রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের চীফ টেকনিক্যাল অফিসার (সিটিও) আবুল কাশেম খান বলেন, আমাদের এখনও বিদেশী হার্ডওয়্যারের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা বিদেশী সফটওয়্যার নির্ভরও। দেশীয় সফটওয়্যারের ক্ষেত্রেও লোকাল সাপোর্ট সবসময় পাওয়া যায় না। তবে দেশের সফটওয়্যার খাত উন্নতি করায় একসময় আমরা পুরোপুরি দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারব বলে প্রত্যাশা করছি।

বেসিস নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ইবিএল, সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ইউসিবিএল, ব্যাংক এশিয়া, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকসহ বেশিরভাগ ব্যাংক দেশী সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। ইসলামী ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক তাদের সফটওয়্যার নিজেরাই তৈরি করেছে। পদ্মা ব্যাংকও তাদের কয়েকটি সফটওয়্যার নিজেরাই তৈরি করেছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এখনও দেশীয় সফটওয়্যারের আওতায় আসেনি।

Source – Daily Janakantha

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here