পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি বাড়ছে।আমদানি ব্যয় কমার পরও রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কার কারণে এই ঘাটতি বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্থে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮২২ কোটি ২০ লাখ (৮.২২বিলিয়ন) ডলার। গত বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল এর চেয়ে কম; ৭৮০ কোটি ডলার।আমদানি কমায় অর্থবছরের তিন মাস পর্যন্ত পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি আগের অর্থবছরের চেয়ে কম ছিল।২০১৮-১৯ অর্থছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ঘাটতি ছিল ৩৮৫ কোটি ২০ লাখ ডলার।২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ছিল তার থেকে কম ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। তবে রপ্তানি আয়ে ধসের কারণে এর পর থেকেই বাণিজ্য ঘাটতি কমছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) মোট ২ হাজার ৭০৬ কোটি ৬০ লাখ (২৭.০৬ বিলিয়ন) ডলার ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। আর পণ্য রপ্তানি থেকে (এফওবিভিত্তিক, ইপিজেডসহ) আয় করেছে এক হাজার ৮৮৪ কোটি ৪০ লাখ (১৮.৮৪ বিলিয়ন) ডলার। এ হিসাবেই বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮২২ কোটি ২০ লঅখ ডলার। তথ্যে দেখা যায়, এই ছয় মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ২ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর রপ্তানি আয় কমেছে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পুরো সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৪৯ কোটি ৪০ লাখ (১৫.৪৯ বিলিয়ন) ডলার।২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ১৮ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোতে আমদানি খাতে ব্যয় বাড়ার কারণে রপ্তানি আয় বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু এবার আমদানি ব্যয় কমার পরও রপ্তানি আয় কমায় বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে।
সেবা খাতের ঘাটতি ১.৬৫ বিলিয়ন ডলার
সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এ খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬৪ কোটি ৯০ লাখ (১.৬৫ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৬২ কোটি ৪০ লাখ ডলার।মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।
লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার
জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৪ কোটি ৭০ লাখ (১.৩৫ বিলিয়ন) ডলার।গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৩৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই ঘাটতি ছিল ৬৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অথচ অগাস্ট মাস শেষেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রপ্তানি আয়ে ধস নামার কারণে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। একই কারণে আমদানি কমার পরও চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
ফাইল ছবি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, গত দুই অর্থবছরে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি নিয়ে বছর শেষ হয়েছিল। কিন্তু এবার অর্থবছর শুরু হয়েছিল ‘স্বস্তির’ মধ্য দিয়ে ২৪ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে। অগাস্ট পর্যন্ত সেই উদ্বৃত্ত ধরে রাখা গিয়েছিল।“কিন্তু রপ্তানিতে বড় ধাক্কার কারণে সেটা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। গত দুই বারের মতো এবারও মনে হচ্ছে বড় ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কেননা, সহসা রপ্তানি আয় ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।” “উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, রপ্তাণিতে একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে। যদি করোনাভাইরাস চায়নার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে তাহলে গোটা বিশ্ব অর্থনীতিকে তছনছ করে দেবে। ছোট-বড় সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা, চীন এখন এমন বৃহৎ অর্থনৈতিক পরাশক্তির একটি দেশ, যার সঙ্গে সব দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে।” “এখন সব কিছুই নির্ভর করছে রোগটি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তার উপর,” বলেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর। গত অর্থবছরে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্সে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঘাটতি থাকলেও সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যে (ওভারওল ব্যালান্স) উদ্বৃত্ত ছিল।
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত
তবে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত হয়েছে বাংলাদেশের। ২ কোটি ৭০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষ হয়েছে।অথচ পাঁচ মাস শেষেও (জুলাই-নভেম্বর) ৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঘাটতি ছিল। তবে আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ১৭৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ১৩০ কোটি ডলার। চলতি হিসাবের ভারসাম্য ৫২৫ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বড় ঘাটতি (ঋণাত্মক) নিয়ে শেষ হয়েছিল গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল আরও বেশি ৯৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।
এফডিআই বেড়েছে ৪%
গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। গত অর্থছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ২২০ কোটি ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশে। এই অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ২৭৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ হিসাবে চার মাসে এফডিআই বেড়েছে ৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এই ছয় মাসে বাংলাদেশে নিট এফডিআই এসেছে ১৩৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আগের বছরে একই মাসে এসেছিল ১১২ কোটি ডলার। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকেই নিট এফডিআই বলা হয়ে থাকে।
পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগে খরা
তবে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) প্রবাহের গতি গতবারের মতোই হতাশাজনক। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে মাত্র ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল সামান্য বেশি; ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ বাংলাদেশে এসেছে ২৫৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আগের বছরের এই ছয় মাসে এসেছিল ২৭৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
Source – BDNews24