দীর্ঘদিনের পতনের ধারা থেকে বেরিয়ে আসা দেশের শেয়ারবাজারে অনেক দিন পর এক বিরাট উত্থান দেখেছেন বিনিয়োগকারীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ও ব্যাংক খাতের ইতিবাচক উদ্যোগের প্রভাবে বাজারের এই উত্থান। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিপালন ও বাস্তবায়ন হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে। আর তাতে বাজারের ইতিবাচক প্রবণতা টেকসই হবে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিনিয়োগকারীরা যে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের প্রতি আস্থা রেখেছেন, তারই প্রতিফলন দেখা গেছে সপ্তাহের প্রথম দিনের লেনদেনে। রবিবার (১৯ ডিসেম্বর) একসময় এমন হয়েছে যে, ডজন খানেক কোম্পানির শেয়ারের কোনো বিক্রেতা ছিল না। ফলে এগুলো সার্কিট ব্রেকারের চূড়ান্ত সীমা স্পর্শ করে। দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে এদিন প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ২৩২ পয়েন্ট। আর অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে বেড়েছে ৫৭৭ পয়েন্ট।
কদিন আগেও ক্রেতা সংকটের কারণে টানা দরপতনের কবলে ছিল পুঁজিবাজার। দফায় দফায় দাম কমিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি বিনিয়োগকারীরা। রবিবার সেসব কোম্পানির শেয়ার দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও বিক্রেতা পাওয়া যায়নি। ফলে সূচকের পাশাপাশি লেনদেনও বাড়ে দুই বাজারে।
এদিন ডিএসইতে মোট লেনদেন হয় ৪১১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, যা আগের কার্যদিবস বৃহস্পতিবারের চেয়ে ১৪৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বেশি। আর লেনদেনে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দর কমে। দর বাড়ে ৩৪৬টির এবং অপরিবর্তিত থাকে ৪টি কোম্পানির শেয়ার দর।
পুঁজিবাজার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার তার নিজ কার্যালয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে যে বৈঠক করেন, তাতে পুঁজিবাজার উন্নয়নে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর বিএসইসি থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে যে ধরনের সাহায্য প্রয়োজন সরকার ধারাবাহিকভাবে তা করে যাবে। স্বল্পমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ অচিরেই কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সে বিষয়ে মতামত দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, মার্চেন্ট ব্যাংকার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণসুবিধা পর্যালোচনা, আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাজারে আস্থা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাজারে মানসম্পন্ন আইপিও বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহুজাতিক ও সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিএসইসির বৈঠকের পর রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজারের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা হলেও আস্থা ফিরেছে বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, আর আস্থা বাড়লে বাজারে অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের ছয়টি নির্দেশনার ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আশার প্রতিফলন দেখা গেছে। এ কারণে শেয়ারবাজারের সূচক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেছে সপ্তাহের শুরুতে। এ ছাড়া শেয়ারের দরপতন হতে হতে এমন পর্যায়ে নেমেছে যে আর কমার সম্ভাবনা কম। বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন এখন শেয়ার কেনার উপযুক্ত সময়।
২০১০ সালের ধসের পর থেকে এ পর্যন্ত সরকার একাধিকবার বড় আকারের তহবিলের জোগানের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু বাজারে কোনো টেকসই স্থিতিশীলতা আসেনি। আবার ১০ হাজার কোটি টাকা তহবিল চাওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এবার এর কোনো দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এটা তো ঋণ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের দেয়া হচ্ছে। তারা এটা পরিশোধ করলে আবার ঋণ পাবে। আর প্রধানমন্ত্রীর ৬টি নির্দেশনার পাশাপাশি শেয়ারবাজারের মৌলিক কিছু সমস্যা যদি সমধান করা যায়, এবং ভালো কোম্পানির শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করা গেলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও বাড়তে পারে। তাতে এই ইতিবাচক প্রবণতা টেকসই হতে পারে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য ব্রোকারেজ হাউসের মালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালীর মতে দুটি কারণে শেয়ারবাজারে আজ সূচক বেড়েছে। এর একটি হলো প্রধানমন্ত্রীর শেয়ারবাজার নিয়ে আন্তরিকতা ও ৬টি বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা। এবং আরেকটি হলো স্কয়ার কোম্পানির দুজন পরিচালকের ছয় লাখ শেয়ার কেনার ঘোষণা।
কত দিন বাজার ইতিবাচক থাকতে পারে জানতে চাইলে লালী বলেন, পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে বেশ সময় লাগবে। পাশাপাশি অনেক কিছু করা দরকার। যেমন ডিএসইর সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় বিশ্ব শেয়ারবাজারকে অনুসরণ করতে হবে। গবেষণা বিভাগ শক্তিশালী করতে হবে।
ডিবিএর এই সাবেক সভাপতি আরও বলেন, যে প্রণোদনা চাওয়া হয়েছে সেটি আসলে ঋণ। সুদ ও আসল পরিশোধের বছর নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে এ অর্থ সরকার দিলে বাজারের তারল্য সংকট কিছুটা লাঘব হবে।
পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট কমাতে ইতিমধ্যে বিনিয়োগ শুরু করেছে সরকারি চার ব্যাংক। গত ১৪ জানুয়ারি পুঁজিবাজার নিয়ে বিএমবিএর সঙ্গে বৈঠক করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেখানে শেয়ারবাজারের তারল্য সংকট নিরসনে সরকারি চার ব্যাংককে বিনিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনার পর সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে। গত ১৬ জানুয়ারি সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সরকারি চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ত্রৈমাসিক বৈঠকে বিনিয়োগের তথ্য জানানো হয়।
Source – Dhaka Times.