অস্বাভাবিক হারে কমছে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি। একই সাথে কমছে রফতানি আয়। রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় ও কাঙ্খিত হারে বৈদেশিক মুদ্রা অবমুক্তি না হওয়ায় বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে। মাত্র ৬ মাসেই প্রায় পুরো বছরের ঋণ নেয়া হয়েছে ব্যাংকিং খাত থেকে। ব্যাংক খাত থেকে অধিকমাত্রায় ঋণ নেয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে।
এ দিকে আমানতের সুদহার কমানোর চাপে আমানত প্রবাহ বাড়ছে না। ফলে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে ধার নিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবারও রেপো ও বিশেষ রেপোর মাধ্যমে তিনটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে একমাত্র রেমিট্যান্স বাদে অর্থনীতির সব সূচকগুলোই নেতিবাচক হয়ে পড়েছে। যেখানে জনসংখ্যার তুলনায় বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান প্রয়োজন, সেখানে উল্টো দিকে যাচ্ছে কর্মসংস্থান। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে বলে তারা মনে করছেন।
বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে গত কয়েক বছর যাবত ব্যাংকব্যবস্থা থেকে কম ঋণ নেয়া হতো। এর অন্যতম কারণ ছিল সঞ্চয়পত্র। কিন্তু টিআইএন বাধ্যতামূলক করায় ও নানা বিধিনিষেধ দেয়ায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত নভেম্বরে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ হয়েছে ৩২০ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় আলোচ্য সময়ে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৯২ শতাংশ। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ অস্বাভাবিকহারে কমে যাওয়ায় ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম ৬ মাসেই (জুলাই-২৮ডিসেম্বর) ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে ৪৬ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৬ মাস বাকি থাকতেই পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার ঋণ নেয়া হয়েছে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। ঋণের হার বেড়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংকেরই নগদ টাকায় টান পড়েছে।
এ দিকে যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বিনিয়োগ অবস্থা খারাপ। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বলা চলে তলানিতে নেমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ১০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। গত নভেম্বরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে নেমেছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে। যেখানে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৯১ শতাংশ।
আর চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের (জুলাই-নভেম্বর) হিসেবে সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল মাত্র ৩ শতাংশ। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমলেও সরকারের ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে।
এদিকে বেসরকারি ঋণের মধ্যে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র স্থাপনের হারের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ১৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৫ শতাংশ। সেই হিসেবে আলোচ্য সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ২৪ শতাংশ। একই সাথে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র স্থাপনের হারের প্রবৃদ্ধিও ঋণাত্মক। অর্থাৎ, প্রায় ৮ শতাংশ ঋণাত্মক হয়েছে।
রফতানি আয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাড়ছে না বরং দিন দিন কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। যেখানে আগের বছরে একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল পৌনে ১৫ শতাংশ। তৈরী পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাওয়ায় অনেকেই লোকসানের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এতে নতুন নতুন কারখানা আসছে না বরং বন্ধ হয়ে গেছে অনেক চালু কারখানা।
অপর দিকে নিট ওয়্যার ও ওভেনেও একই অবস্থা। ভালো নেই দেশের টেক্সটাইল খাত। এ দিকে রফতানি আয় কমলেও কাক্সিক্ষত হারে অবমুক্তি হচ্ছে না বৈদেশিক ঋণ। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপরই চাপ বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে টাকা ডলারের বিনিময় মূল্যের ওপর। প্রতিনিয়তই টাকার মান কমে যাচ্ছে।
যেমন : গত বছরের ৮ জানুয়ারি প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় করতে হতো ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা, চলতি ৮ জানুয়ারিতে তা হয়েছে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু বাস্তব অবস্থা আরও বেশি। ব্যাংকগুলো করপোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে দুই-তিন টাকা বেশি হারে লেনদেন করছে। সামনে এ বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট আরও বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে।
ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থাও ভালো নেই। অস্বাভাবিকহারে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। বিপরীতে ঋণ আদায় কমে গেছে। অপর দিকে আমানতের সুদহার কমানোর চাপ রয়েছে। এর ফলে আমানত প্রবাহ কমে গেছে। ব্যাংকগুলো অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চলছে। ঋণ অবলোপন করে ও ডাউন পেমেন্ট নামেমাত্র নিয়ে খেলাপি ঋণ কমানো হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোতে কৃত্রিম আয় বেড়ে গেছে।
এ কৃত্রিম আয়ের ওপর ভর করেই সরকারের ৪০ শতাংশ কর পরিশোধ করা হচ্ছে। নগদে লভ্যাংশ বিতরণের নামে ব্যাংকের অর্থ বের হয়ে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেছে। একইসাথে বাড়ছে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ। সবমিলে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা যেমন কমছে তেমনি মূলধন হারানোরও অনেকের আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও এর কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার অর্থ হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় শিল্প স্থাপন তথা কর্মসংস্থান কম হওয়া। তাদের মতে, প্রতিবছরই দেশের শ্রম বাজারে ২০ থেকে ২৫ লাখ নতুন মুখ আসছে, সেখানে বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান না হলে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে যাবে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। এতে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাধাগ্রস্ত হবে। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় অর্থনীতিকে বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।
Source – Daily Nayadiganta.