বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক সংকট চলতি ২০২০ সালে মন্দায় রূপ নিচ্ছে! ইতিপূর্বেকার আভাসে এমনটি বলা হলেও সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্য সংকটে মন্দার আঁচে হাওয়া লেগেছে—এমন মন্তব্যই করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ দিয়ে শুরু হওয়া সংকট নানা কারণে আরো ঘনীভূত হচ্ছে এবং দ্রুতই এর প্রভাব পড়তে পারে ধনী-দরিদ্র দেশগুলোতে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয় মন্তব্য করে কেউ কেউ বলেছেন, এখনি সতর্ক হতে হবে।
২০১৭ ও ২০১৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতি সুসংহতই ছিল বলা যায়। পরবর্তীকালে তাতে চির ধরে এবং গত বছরই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সতর্ক করে বলেছিল, চীন-মার্কিন বাণিজ্যবিরোধের সমাধান না হলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হবে। যার ধারাবাহিকতায় ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো প্রায় সব দেশেরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারণার চেয়ে কম হওয়ার পূর্ভাবাস দিয়েছে।
আইএমএফ গত বছর সতর্ক করে বলেছিল, ২০১৭ ও ২০১৮ এই দুই বছর সুসংহত প্রবৃদ্ধির পর বিশ্ব অর্থনীতি প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি শ্লথ হয়ে পড়েছে। এমনকি ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ইউরোপের অর্থনীতিতে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বহির্মুখী প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখন একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে নীতিনির্ধারকরা কীভাবে এর জবাব দেন তার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করছে অর্থনীতি কেমন যাবে।
নতুন বছরের শুরুতেই যোগ হলো মধ্যপ্রাচ্য সংকট। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ইরাক—ইরান ইস্যু ও ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলেইমানি হত্যার প্রভাবে ইতিমধ্যে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হলে এখনকার ৭০ ডলারের জ্বালানি তেল ৮০ ডলার ছাড়াবে বলে পূর্ভাবাসও দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তেল রপ্তানি করা হয় হরমুজ প্রণালীর মাধ্যমে। ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রণালীটি ওমান উপসাগর ও পারস্য উপসাগরকে সংযুক্ত করেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, কুয়েত, ইরান, কাতার এই পথে তেল রপ্তানি করে। এর আগে ১৯৭০ ও ১৯৯০-এর দশকে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতায় বিশ্বব্যাপী তেলের দামে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বিশ্ব অর্থনীতির গতিও কমে যায়। নতুন করে শুরু হওয়া উত্তেজনায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর তেল উত্তোলন কমে যেতে পারে, ফলে আরো দাম বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নতুন বছরের শুরুতে কাসেম সোলেইমানিকে ইরাকে হত্যার পর শুধু তেলের বাজার নয়, বৈশ্বিক শেয়ারবাজারেও বেশ তোলপাড় তুলেছে। মার্কিন ও এশীয় শেয়ারবাজারে দেখা গেছে মন্দাভাব। অন্যদিকে স্বর্ণ, ইয়েন ও সরকারি সঞ্চয়পত্রের বাজারে দেখা গেছে বড়ো ধরনের উল্লম্ফন। মধ্যপ্রাচ্যের এই অস্থিরতা যদি যুদ্ধে রূপ নেয়, সে ক্ষেত্রে এই অঞ্চলে মুদ্রামানে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ইরান যদি ইরাকের দক্ষিণ অঞ্চলে মার্কিন প্রভাবের তেল স্থাপনায় হামলা করে অথবা হরমুজ প্রণালীতে তেল চলাচলে বাধা দেয়, সেক্ষেত্রে তেলের দাম ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ইউরোএশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে। সংকট দ্রুত সমাধান না হলে এই অঞ্চলে অস্থিরতা বাড়বে। শুধু তেলের বাজারই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বিভিন্ন দেশের শ্রমশক্তির বাজারও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এর প্রভাব পড়বে রেমিট্যান্সের ওপর। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইত্তেফাককে বলেন, চলমান অস্থিরতা কতটুকু ছড়িয়ে পড়ে বা কতদিন স্থায়ী হয়, মূলত সেটির ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশে এর কী প্রভাব পড়বে। অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদে রূপ নিলে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের জ্বালানি ব্যয় বাড়বে। ফলে সরকারি ব্যয়ে এক ধরনের চাপ তৈরি হবে। তাছাড়া, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রচুর শ্রমশক্তি কাজ করছে। অস্থিরতা যদি দীর্ঘায়িত হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যাবাসন এবং নতুন করে শ্রমিক প্রেরণের বিষয়টি সমস্যায় পড়বে। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সেসব দেশের দূতাবাসগুলোকে নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, যাতে করে সমস্য তৈরি হলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
Source – The Ittefaq.