চার দিনেই ১৪ হাজার কোটি টাকা নেই

0
286

প্রতিদিনই পড়ছে শেয়ারবাজার। ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধসের পর গত ১০ বছরে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা এখন। এ সপ্তাহের চার দিন টানা বড় পতন হয়েছে। ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শেয়ার দর হারিয়েছে। এতে বাজার সূচকের পতন হয়েছে প্রতিদিনই ১ শতাংশের ওপর। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির পর টানা চার দিন ১ শতাংশের ওপর সূচক পতনের রেকর্ড নেই। বাজারের এ ভয়াবহ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিংবা স্টক এক্সচেঞ্জের কেউ কিছু বলছেন না। শুধু বিনিয়োগকারীদের হাহাকারই শোনা যাচ্ছে।

পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ হলেও এর থেকে উত্তরণের কোনো পথ কেউ বলতে পারছে না। সর্বশেষ গত ২ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদ বৈঠক করে। ওই বৈঠকের পর দরপতন আরও বেড়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অবস্থা দেখা বা শোনার এখন কেউ নেই। এ অবস্থায় গতকাল কয়েকজন বিনিয়োগকারী মুখে কালো কাপড় বেঁধে ডিএসইর সামনে প্রতীকী অবস্থান নেন।

বাজার-সংশ্নিষ্টরা জানান, আরও দরপতনের শঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা লোকসানে শেয়ার বিক্রি করছেন। গত চার দিনে সব শেয়ারের বাজারদর (বাজার মূলধন) ১৪ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা কমেছে। ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। চাকরির কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিদিন এলেও বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। বেশিরভাগই ফোনে অর্ডার দিয়ে শেয়ার কেনাবেচা করছেন।

এ অবস্থায় সাময়িকভাবে হলেও শেয়ারবাজার বন্ধ করার দাবি উঠেছে। ঢাকা ব্যাংকের মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউস ডিবিএল সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ আলী সমকালকে বলেন, এভাবে চোখের সামনে পুঁজি হারাতে দেখার কোনো মানে হয় না। কিছুদিনের জন্য শেয়ারবাজার বন্ধ রাখা হোক। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের আরও কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এমন দাবি করেছেন।

বন্ধ রাখার যৌক্তিকতা বিষয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, যখন গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া শেয়ারের দর ক্রমাগত পতন হয়, বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন, তখন তাদের পরিস্থিতি বুঝতে বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে লেনদেন সাময়িক বন্ধ রাখার বহু নজির আছে। ২০১১ সালের ধসের সময়ও লেনদেন বন্ধ রাখা হয়েছিল। তাই লেনদেন বন্ধ রেখে খুঁজে বের করা হোক কেন দরপতন হচ্ছে। অন্যথায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হোক। কারণ ক্রমাগত দরপতনে প্রতিটি শেয়ারের দর এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, এখান থেকে আরও দর হারানোর যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।

জানতে চাইলে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএমবিএর সভাপতি ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্রোকারেজ হাউস ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছায়েদুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘পরিস্থিতি খুবই খারাপ, ভয়াবহ। বিনিয়োগকারীদের কথা কী বলব, নিজেরাই চলতে পারছি না।’ ছায়েদুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে কোনো পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উদ্যোগ আছে বলে জানা নেই। বাজারের অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার হিসেবে বিএমবিএ কোনো ধরনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা কী করব। স্টক এক্সচেঞ্জ আছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি আছে। তারও ওপরে আছে সরকার। হয়তো সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কোনো চিন্তাভাবনা আছে।’

তলানিতে থাকা শেয়ারের দরও কী কারণে কমছে, তার কারণ সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে না পারলেও কেউ কেউ মনে করছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকের সুদহার বেঁধে দেওয়ার ঘোষণা বর্তমানের দরপতনের বড় কারণ। শেয়ারবাজারের অন্যতম প্রধান মার্চেন্ট ব্যাংক আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, সুদের হার ৯ শতাংশে বেঁধে দিলে ব্যাংকের মুনাফায় ধস নামবে- এমন শঙ্কায় বড়-ছোট সব বিনিয়োগকারী ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। এ কারণে দরপতন হচ্ছে।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ালি-উল মারুফ মতিন বলেন, সুদহার বেঁধে দিলে তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংক কোম্পানির শেয়ারদর কমতে পারে। বাকি ৩০০ কোম্পানির শেয়ারদর কমার কারণ নেই। বাজার পতনের বড় কারণ সুশাসনের অভাব। এ কারণে মানুষের মধ্যে বিনিয়োগ করার আস্থা নেই।

ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, সুদহার নির্ধারণের প্রসঙ্গটি আসার অনেক আগে থেকেই দরপতন হচ্ছে। তা ছাড়া শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে বেঁধে দিলে অনেকে ব্যাংকে টাকা না রেখে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আসবেন। এটা ভালো দিক। কিন্তু এ ভালো দিকের প্রভাব কেন বাজারে নেই। তারা বলেন, মন্দ শেয়ার বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিনিয়োগ করার অর্থ নেই। কারণ ওই শেয়ার কিনে সবাই লোকসানে। সর্বশেষ রিং শাইন টেক্সটাইল কোম্পানির শেয়ার তালিকাভুক্তির মাত্র এক মাসের মধ্যে অভিহিত মূল্য ১০ টাকার নিচে নেমেছে। তালিকাভুক্তির এক মাসেরও কম সময় পর শেয়ারটি গতকাল ৮ টাকা ৯০ পয়সায় কেনাবেচা হয়েছে। অথচ লেনদেন শুরুর দ্বিতীয় দিনে গত ১৫ ডিসেম্বর ২১ টাকা ৯০ পয়সায় কেনাবেচা হয়েছিল।

গতকাল বুধবার প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৭১ শতাংশ শেয়ারের দরপতন হয়েছে। এমন দরপতনে প্রধান সূচক ৫৩ পয়েন্ট হারিয়ে ৪২২৮ পয়েন্টে নেমেছে।

চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে কয়েকদিন ধরে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন, সংস্থাটির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তারা সাড়া দেননি। স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালকরাও কথা বলতে রাজি নন। জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পুরোপুরি আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে শেয়ার লেনদেন ২-৩ দিন বন্ধ রাখার নজির আছে। ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধান না হলে শেয়ারবাজার সমস্যার সমাধান আছে বলেও মনে হয় না। বিষয়টি সরকারের গুরুত্ব দিয়ে বিকল্প কিছু খোঁজা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কমিটি :এদিকে শেয়ারবাজার সংকট ইস্যুতে কাজ করতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাকসুরা নুর এ কমিটির সমন্বয়ক। অন্যরা হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির একজন নির্বাহী পরিচালক এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কমিটির সদস্য সচিব আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব নাহিদ হোসেন।

source – samakal

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here